,

পোশাক খাতে অস্থিরতা: বকেয়া বেতন পরিশোধে ব্যর্থ হলে প্রশাসক নিয়োগের হুঁশিয়ারি

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে চলমান অস্থিরতা নিরসনে সরকার মালিকপক্ষের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে।

বকেয়া বেতন-ভাতা এবং অন্যান্য দাবিতে গত তিন মাস ধরে শ্রমিকরা নিয়মিত আন্দোলন করছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছেন, বেতন পরিশোধে ব্যর্থ হলে কারখানাগুলোর ওপর প্রশাসক নিয়োগ করা হবে।

মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ের এক মতবিনিময় সভায় শ্রম উপদেষ্টা এ বক্তব্য দেন।

প্রশাসক নিয়োগের প্রেক্ষাপট

শ্রম উপদেষ্টা জানিয়েছেন, বেশিরভাগ সমস্যা তৈরি হয়েছে বকেয়া বেতন নিয়ে।

বেশ কিছু কারখানা ঋণখেলাপির কারণে ব্যাংক থেকে অর্থ পাচ্ছে না।

এই পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের দাবিগুলো সমাধান করতে কারখানাগুলোতে প্রশাসক নিয়োগের কথা ভাবা হচ্ছে।

তিনি বলেন, “যেসব কারখানা তিন-চার মাসের বেতন বকেয়া রেখেছে এবং চলমান সংকট মোকাবিলায় সক্ষম নয়, সেগুলোতে প্রশাসক বসানো হবে।”

আইনগত প্রক্রিয়া এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ

শ্রম উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছেন, প্রশাসক নিয়োগের বিষয়ে প্রক্রিয়া এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

তিনি বলেন, “আমরা আইনের মধ্যে থেকেই এ কাজটি করব। প্রয়োজনে আইন পরিবর্তন কিংবা নতুন অধ্যাদেশ জারি করা হবে।”

কারখানাগুলো সাধারণত ব্যক্তি মালিকানাধীন হওয়ায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে আইনত কিছু জটিলতা রয়েছে।

তবে শ্রম উপদেষ্টা বলেছেন, “যদি কারখানার মালিক ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে, তবে সরকারেরও মালিকানার একটা অংশ রয়েছে।”

শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা

শ্রম উপদেষ্টা আরও জানিয়েছেন যে শ্রমিকদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করবেন।

তিনি বলেন, “কিছু কারখানায় গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলব। তারপর মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব।”

এ ধরনের উদ্যোগ সরকারের সংকট সমাধানের সদিচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

বিজিএমইএ-তে প্রশাসক নিয়োগের অভিজ্ঞতা

এর আগে বিজিএমইএ-তে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে বর্তমান সরকার।

গত ২০ অক্টোবর রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেনকে বিজিএমইএ’র প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

বিজিএমইএ-তে প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্তও ছিল সরকারের বড় পদক্ষেপ।

মালিকদের উদ্বেগ এবং প্রস্তাবনা

পোশাক শিল্পের মালিকরা প্রশাসক নিয়োগের বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

ডেনিম এক্সপার্ট গার্মেন্টসের মালিক মহিউদ্দিন রুবেল বলেছেন, মালিক নিরুদ্দেশ হলে বা ঋণখেলাপির কারণে কারখানা বন্ধ হওয়ার পরিস্থিতি এলে প্রশাসক নিয়োগ হতে পারে।

তবে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, সাধারণ পরিস্থিতিতে প্রশাসক নিয়োগ কতটা কার্যকর হবে।

তিনি বলেন, “যদি মালিক ইচ্ছাকৃত কোনো ভুল না করে, তবে সরকার সরাসরি সমাধানের জন্য মনিটরিং এবং সহায়তার ব্যবস্থা করতে পারে।”

সাময়িক সমাধান নাকি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা?

গবেষণা সংস্থা সিপিডি-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান মনে করেন, প্রশাসক নিয়োগ সাময়িক সমাধান।

তিনি বলেন, “ফরেনসিক অডিট এবং কেস বাই কেস ডিসিশনের মাধ্যমে সমস্যাগুলো সমাধান করা উচিত।”

তার মতে, পোশাক শিল্পের মতো সংবেদনশীল খাতে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করাই হবে সরকারের প্রধান দায়িত্ব।

দেশের ভাবমূর্তির ওপর প্রভাব

পোশাক খাত দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি আয়ের উৎস।

অল্প সংখ্যক কারখানার সংকট পুরো শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সুনাম বজায় রাখতে এবং আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা ধরে রাখতে শ্রমিকদের দাবিগুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত।

অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা

বাংলাদেশে এর আগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগের উদাহরণ রয়েছে।

২০২০ সালে প্রিমিয়ার লিজিং এবং পিপলস লিজিং-এর মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

তবে এগুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আইনি জটিলতা তৈরি হয়েছে।

“নগদ”-এ প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও আদালতে মামলা হয়েছে।

ভবিষ্যতের করণীয়

শ্রম উপদেষ্টার মতে, পোশাক খাতে এই সংকট সমাধানে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।

তিনি বলেন, “যে কারখানা চলতে পারবে না, সেগুলোতে প্রশাসক বসানো হবে। তবে সেটা হবে আইনের আওতায়।”

শ্রমিকদের আশার আলো

সরকারের এ পদক্ষেপ শ্রমিকদের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সময়োপযোগী এবং সঠিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পোশাক খাতের অস্থিরতা নিরসন সম্ভব।

সরকারের কাছে শ্রমিক এবং মালিকদের আস্থার জায়গা তৈরির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার চ্যালেঞ্জও রয়েছে।

এখন দেখার বিষয়, প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে সরকারের প্রস্তাব কতটা কার্যকর হয় এবং পোশাক খাত কীভাবে এই সংকট কাটিয়ে ওঠে।

আরও পড়তে পারেন