বাংলাদেশ পুলিশ
,

পূর্বাচলের ৩০০ ফিট সড়ক: দর্শনার্থীদের স্বপ্নজাল, দুর্ঘটনার মৃত্যুজাল

ঢাকার পূর্বাচল ৩০০ ফিট সড়ক রাজধানীবাসীর জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।

এর মায়াবী আলোকসজ্জা এবং দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থীকে আকর্ষণ করছে।

তবে, এই সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে মৃত্যুর ছায়া।

সড়কটি এখন অপরাধ ও দুর্ঘটনার জন্য ভয়ঙ্কর এক স্থান।

বেপরোয়া গাড়ি চালানো, মাদকাসক্তি, অপরাধীদের কর্মকাণ্ড এবং আইনশৃঙ্খলার অভাব এই সড়ককে মৃত্যু ও আতঙ্কের নাম দিয়েছে।

অপরাধ ও দুর্ঘটনার গতি বাড়ছে

৩০০ ফিট সড়কটি একদিকে রাজধানীবাসীর মানসিক প্রশান্তি আর যান্ত্রিক জীবনের অবসাদ দূর করার জায়গা।

অন্যদিকে প্রতিনিয়ত ছিনতাই, ডাকাতি, খুন এবং মাদক সেবনের মতো অপরাধের খবর আসছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এই সড়কে প্রতিদিনই কোনো না কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে।

এ সড়কের সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধ হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থীরা আসছেন।

কিন্তু অপরাধ ও দুর্ঘটনার কারণে এখন তারা এখানে আসতেও ভয় পাচ্ছেন।

শুধু ২০২৪ সালেই এই সড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ১২ জন।

গত পাঁচ বছরে মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়েছে শতাধিক।

স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “এই সড়কে পরিবার নিয়ে আসতে ভয় পাই। আতঙ্কে থাকি, যদি কোনো গাড়ি এসে ধাক্কা দেয়।”

মোটরসাইকেল ও স্পোর্টস কারের বেপরোয়া গতি

রাতের বেলা ৩০০ ফিট সড়কে স্পোর্টস কার এবং মোটরসাইকেলের দল দেখা যায়।

তারা বিপজ্জনক স্ট্যান্টবাজি এবং প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে, যার ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে।

পুলিশ জানিয়েছে, এদের বেশির ভাগই মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালায়।

রাতের নীরব সড়ক তাদের কাছে যেন একটি খেলার মাঠ হয়ে ওঠে।

সম্প্রতি বুয়েটের শিক্ষার্থী মুহতাসিম মাসুদ প্রাইভেট কারের ধাক্কায় নিহত হন।

তার আগে একই সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান সুজনা ও কাব্য।

গত আট বছরে এখানে ২১ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে, যাদের বেশির ভাগই হত্যার শিকার।

একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, “যারা এই ধরনের বেপরোয়া গতি বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত, তাদের মধ্যে অধিকাংশই প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে নানা চাপের মুখে পড়তে হয়।”

অপরাধীদের নিরাপদ আস্তানা

সড়কটি অপরাধীদের জন্য একটি নিরাপদ স্থান হয়ে উঠেছে।

স্থানীয়রা বলছেন, এখানে প্রায়ই মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়।

অপরাধীরা অন্য কোথাও খুন করে এখানে মরদেহ ফেলে রেখে যায়।

পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, “যারা এখানে অপরাধ করছে, তারা এই সড়কের নিরাপত্তাহীনতার সুযোগ নিচ্ছে।”

স্থানীয় মেহেদী হাসান জিয়া বলেন, “পুলিশ নিয়মিত তদারকি করলে এবং কঠোর ব্যবস্থা নিলে অপরাধের হার কমানো সম্ভব।”

টিকটকার ও কন্টেন্ট নির্মাতাদের বিশৃঙ্খলা

সড়কের মায়াবী পরিবেশ এবং আলোকসজ্জা অনেক টিকটকার এবং কন্টেন্ট নির্মাতাদের আকর্ষণ করছে।

তারা রাস্তার মাঝখানে গাড়ি থামিয়ে ভিডিও তৈরি করে, যার ফলে ট্রাফিক ব্যাহত হয় এবং দুর্ঘটনার শঙ্কা বাড়ে।

একজন দর্শনার্থী জানান, “যেখানে-সেখানে গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলছে, ভিডিও বানাচ্ছে। এতে চলাচলকারী অন্যান্য যানবাহন বিপদে পড়ে।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রবণতা বন্ধে কঠোর নিয়ম এবং জরিমানা কার্যকর করা প্রয়োজন।

আইনশৃঙ্খলার শূন্যতা

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, সড়কে চেকপোস্ট বসানো হলেও অপরাধীদের ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না।

চেকপোস্টে আটকানোর পর প্রভাবশালী মহলের তদবির এবং ফোন কল আসে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, “এটি ওয়ানওয়ে রোড হওয়ায় রাতে ট্রাফিক পুলিশ রাখার প্রয়োজন পড়ে না। তবে ক্রাইম ডিভিশন নজরদারি করে।”

নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, সড়কে নীলা মার্কেটের জন্য মানুষের ভিড় বেশি।

তিনি বলেন, “নীলা মার্কেট সারারাত খোলা থাকায় অপরাধ বাড়ছে। রাত ১২টা পর্যন্ত সময়সীমা নির্ধারণ করতে হবে।”

সড়ক নিরাপত্তায় সুপারিশ

সড়ক ও দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৩০০ ফিট সড়কে স্পিড মিটার বসাতে হবে এবং গতিসীমা নির্ধারণ করতে হবে।

তাদের মতে, সড়কের সিসি ক্যামেরা স্থাপন এবং নজরদারি বাড়ানো গেলে দুর্ঘটনা এবং অপরাধ কমানো সম্ভব।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক জানান, “স্পিড ক্যামেরা দিয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে এবং আইন ভঙ্গকারীদের শাস্তি দিতে হবে।”

স্থানীয় বাসিন্দারাও সড়কে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তার দাবি তুলেছেন।

একজন বাসিন্দা বলেন, “নিয়মিত পুলিশি তদারকি এবং আইন প্রয়োগ ছাড়া এই সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অসম্ভব।”

আরও পড়তে পারেন