মেধাতালিকায় ১৪তম অবস্থান; শোক প্রকাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদ, যিনি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন, তার স্নাতক চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আবু সাঈদ সম্মিলিত মেধাতালিকায় ১৪তম স্থান অধিকার করেছেন এবং সিজিপিএ ৩.৩০ পেয়েছেন।
উপাচার্য অধ্যাপক মোঃ শওকাত আলীর অনুমোদনক্রমে এই ফলাফল রোববার প্রকাশ করা হয়।
ফলাফল ঘোষণার সময় উপাচার্য বলেন, “আবু সাঈদ মেধাতালিকায় ১৪তম স্থান অধিকার করেছে। এটি আমাদের ভালো লাগার বিষয়। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে আমরা শোকাহত। আমি তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।”
স্নাতক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পাশাপাশি নিহত ছাত্রের স্মরণে শোক প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ২০১৮ সালের ১৬ই জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ।
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আর উল্টো দিক থেকে পুলিশ শটগান দিয়ে গুলি ছুঁড়ছিলো।
এক পর্যায়ে, গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে যান তিনি।
সহপাঠীরা তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়, কিন্তু সেখানে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এই ঘটনা দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
ঘটনার জের ধরে কারফিউ ও সেনা মোতায়েন
আবু সাঈদের মৃত্যুর পরের দিনগুলোতে আন্দোলন আরও বেগবান হয়।
১৮ ও ১৯শে জুলাই সহিংসতা ব্যাপকভাবে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ১৯শে জুলাই রাতে কারফিউ জারি করে এবং বিভিন্ন জায়গায় সেনা মোতায়েন করে।
বিশেষ করে ঢাকাসহ দেশের প্রধান শহরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
সরকারের এ ধরনের কঠোর পদক্ষেপে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও আন্দোলনের উত্তাপ পুরোপুরি থামানো যায়নি।
আবু সাঈদের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু
আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনাটি বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে আছে।
তার মৃত্যুর পর শিক্ষার্থীরা সহিংসতার শিকার এবং আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া নিয়ে নানা বিতর্ক ও আলোচনা শুরু হয়।
একদিকে সরকার বলছে, আন্দোলনকারীরা পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে তুলেছিলো, যার ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কড়া পদক্ষেপ নিতে হয়েছে।
অন্যদিকে, মানবাধিকার সংগঠন ও আন্দোলনকারীরা সরকারের পদক্ষেপের সমালোচনা করে বলেছেন, এটি ছিলো দমনমূলক এবং শিক্ষার্থীদের উপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করা হয়েছিল।
আবু সাঈদের মৃত্যুর পর তার পরিবারের পক্ষ থেকেও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয় এবং ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করা হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের পটভূমি
বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবির প্রেক্ষিতে শুরু হয়।
শিক্ষার্থীরা দাবি করে, সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা তাদের প্রতিযোগিতার সুযোগ কমিয়ে দিচ্ছে।
প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার জন্য কোটা সংস্কার এবং কোটার সংখ্যা কমানোর দাবি জানানো হয়।
শুরুতে আন্দোলনটি ছিলো শান্তিপূর্ণ, তবে পরবর্তীতে পুলিশের হস্তক্ষেপ এবং সহিংস ঘটনার ফলে আন্দোলন তীব্র রূপ নেয়।
আবু সাঈদের মৃত্যুর পর আন্দোলন আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং সরকারের সাথে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হয়।
আবু সাঈদের স্মরণে শোক ও আন্দোলনের নতুন দিক
আবু সাঈদের স্নাতক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর তার সহপাঠী এবং শিক্ষকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
একদিকে, তার সাফল্য নিয়ে গর্ববোধ করছেন সবাই, আবার অন্যদিকে তার অনুপস্থিতি তাদের মনে গভীর শোক ও বেদনার সৃষ্টি করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আবু সাঈদের স্মরণে একটি শোকসভা আয়োজন করেছেন, যেখানে তার স্মৃতিচারণা করা হয় এবং তার জন্য প্রার্থনা করা হয়।
এছাড়া, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমর্থকরা তার মৃত্যুর ঘটনায় বিচার দাবি করে আন্দোলনের নতুন দিক নিয়ে ভাবছেন।
আবু সাঈদের স্মরণে প্রতিবছর একটি স্মারক দিবস পালন করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীরা তার আত্মত্যাগকে স্মরণে রাখতে পারেন।
নিহত শিক্ষার্থীর পরিবার: ‘বিচার চাই’
আবু সাঈদের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, তার মৃত্যুর সঠিক বিচার এখনও হয়নি।
তার মা-বাবা দাবি করেছেন যে, তাদের ছেলেকে বিনা অপরাধে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এবং তারা ন্যায়বিচার পেতে চান।
তিনি আরও বলেন, “আমার ছেলের মৃত্যুর পর আমরা এখনও বিচারের আশায় দিন কাটাচ্ছি। সরকার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।”
আবু সাঈদের পরিবার এবং তার সহপাঠীরা বলছেন, তারা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
মানবাধিকার সংস্থার প্রতিক্রিয়া
মানবাধিকার সংগঠনগুলো আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
বেসরকারি সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সরকারের কাছে এই ঘটনার বিস্তারিত তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।
তাদের মতে, শিক্ষার্থীদের উপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং এটি তদন্তের দাবি রাখে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারও এই ঘটনার উপর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং বাংলাদেশ সরকারকে শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন।
কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের পথ
আবু সাঈদের মৃত্যুর পর সরকার কোটা সংস্কার নিয়ে কিছু পদক্ষেপ নেয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন যে, কোটা ব্যবস্থা সংস্কার করে নতুন নিয়মাবলী প্রণয়ন করা হবে।
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি কিছুটা পরিবর্তন করা হয় এবং সাধারণ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়।
তবে, অনেক শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারীরা মনে করেন যে, কোটা সংস্কারের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন হয়নি।
আবু সাঈদের স্মৃতি ও বাংলাদেশের শিক্ষার্থী আন্দোলনের ইতিহাস
আবু সাঈদের মৃত্যু বাংলাদেশের শিক্ষার্থী আন্দোলনের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
তার মৃত্যুর পর দেশের শিক্ষার্থীরা আরও সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে।
তার স্মৃতিকে স্মরণে রেখে শিক্ষার্থীরা নতুন আন্দোলন ও প্রতিবাদের মাধ্যমে ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়ে আসছে।
আবু সাঈদের আত্মত্যাগ এবং তার স্মৃতিকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থী আন্দোলনের নতুন দিগন্ত খুলে যায়।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা তার স্মৃতিকে স্মরণে রেখে আন্দোলন ও প্রতিবাদের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
তার এই আত্মত্যাগ শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন সংগ্রামী শিক্ষার্থী হিসেবে তার নাম অমর হয়ে থাকবে।