সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, দলের অভ্যন্তরে চলছে জল্পনা-কল্পনা
‘আমরা এই দেশে জন্মেছি, এই দেশে মরব, পালাব না। কোথায় পালাব! পালাব না, প্রয়োজনে ফখরুল সাহেবের বাসায় গিয়ে উঠব।’—গত বছরের ২৯ জানুয়ারি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে উদ্দেশ করে এভাবেই বলেছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা মাঠে আয়োজিত আওয়ামী লীগের এক জনসভায় তিনি এ বক্তব্য দেন। সেসময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এরপর দেড় বছরের মধ্যে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেক পাল্টে গেছে। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার বুকে বয়ে গেছে অজস্র পানি।
বিএনপির আন্দোলন নস্যাৎ করে আওয়ামী লীগ গত ৭ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে। কিন্তু গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এরপর থেকে ওবায়দুল কাদের কোথায় আছেন, সে সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি আত্মগোপনে চলে গেছেন এবং শারীরিক বা ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতি নেই।
সরকার পতনের আগে প্রতিদিন বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়া ওবায়দুল কাদেরের গত দুই মাস ১০ দিন ধরে কোনো বক্তব্য বা বিবৃতি পাওয়া যায়নি।
‘পালাব না’ বক্তব্য নিয়ে গান, মিম এবং প্যারোডি
ওবায়দুল কাদেরের ‘পালাব না’ বক্তব্য নিয়ে সম্প্রতি গান তৈরি হয়েছে, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে। তার বিভিন্ন বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে মিম এবং প্যারোডি।
সরকার পতনের পর শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের বেশির ভাগ নেতাই দেশ ছেড়েছেন। তাঁদের অনেকেই ভারতে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।
শুধু শীর্ষ নেতা নয়, মাঝারি এবং সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতা-কর্মীও ভারতে রয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। অনেক নেতা বিদেশ থেকে গণমাধ্যমকর্মী ও নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কমবেশি যোগাযোগ রাখছেন।
কিন্তু প্রায় আড়াই মাসের এই সময়ে কেউই ওবায়দুল কাদেরের অবস্থান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি। এমনকি তাঁর সঙ্গে কোনো নেতা বা কর্মীর যোগাযোগ হয়েছে এমন কোনো তথ্যও পাওয়া যায়নি।
‘খেলা হবে’ বলে নিজেই লোকচক্ষুর আড়ালে
ওবায়দুল কাদেরের অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে নানা গুঞ্জন চলছে। কেউ কেউ বলছেন, তিনি ৫ আগস্টেই যশোর সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে গেছেন। আবার কারও মতে, তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থান করছেন।
আরও কিছু ধারণা আছে যে, তিনি দেশের ভেতরেই কোনো এক জায়গায় আত্মগোপনে আছেন।
ওবায়দুল কাদেরের ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতা জানান, ৫ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত ওবায়দুল কাদের ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় অবস্থান করছিলেন। এরপর তাঁর সঙ্গে কারও যোগাযোগ হয়েছে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
শেখ হাসিনা বর্তমানে বিদেশে থাকলেও বিভিন্ন সময়ে দেশ-বিদেশের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ফোনে কথা বলছেন। তবে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে কারও কথা হয়েছে এমন কোনো তথ্য নেই।
সরকারের পতনের আগে প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিতেন তিনি। ‘খেলা হবে’ স্লোগানের মাধ্যমে মাঠে নামতেন। কিন্তু এখন নিজেই চলে গেলেন লোকচক্ষুর আড়ালে। এ নিয়ে দলে চলছে নানা আলোচনা।
দলে ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে বিস্ময়
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ওবায়দুল কাদেরের আচমকা অনুপস্থিতি নিয়ে বিস্ময় রয়েছে। দলীয় নেতারা বলছেন, ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছিলেন সক্রিয়।
এক–এগারোর আগে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর প্রথমে মন্ত্রিসভায় স্থান না পেলেও পরে ২০১১ সালে যোগাযোগমন্ত্রী হন। তারপর থেকে গণমাধ্যমে প্রায় নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন।
২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে আসীন হওয়ার পর তার উপস্থিতি আরও বৃদ্ধি পায়। তিনি দলের প্রতিদিনের কার্যক্রম এবং গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে থাকতেন।
কিন্তু সরকারের পতনের পর তিনি নিখোঁজ হয়ে গেলেন! এটি দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে।
দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং দোষারোপ
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলের অভ্যন্তরে দোষারোপ এবং দলে বিভাজন দেখা দিয়েছে।
সরকার পতনের পর শেখ হাসিনা এবং অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের দেশত্যাগের পরে দলীয় নেতারা একে অপরকে দায়ী করছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে চলছে আলোচনা।
অনেক নেতা মনে করেন, ওবায়দুল কাদেরের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে দলের ভেতরের বিভিন্ন বিতর্ক এবং তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সমালোচনার প্রভাব থাকতে পারে।
দলের কিছু নেতার মতে, সরকার পতনের পর নিজের অনিরাপত্তার আশঙ্কায় তিনি আত্মগোপনে চলে গেছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অনুপস্থিত
ওবায়দুল কাদেরের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে সর্বশেষ পোস্ট ছিল ৫ জুলাই। ওই পোস্টে তিনি পদ্মা সেতুর একটি এলাকায় নিজের বিভিন্ন ভঙ্গিমায় তোলা ১২টি ছবি শেয়ার করেন।
পোস্টটি ব্যাপক সাড়া ফেলে; ৫২ হাজারের বেশি মানুষ ‘হা হা’ রিয়েক্ট দেন এবং অনেকেই সমালোচনামূলক মন্তব্য করেন।
এরপর থেকে তার পেজে আর কোনো পোস্ট নেই।
এর আগে নিয়মিত বিরতিতে নিজের ছবি পোস্ট করতেন তিনি। এমনকি বিভিন্ন বিদেশি অতিথির সঙ্গে বৈঠকের ছবিও শেয়ার করতেন।
কিন্তু দলীয় কর্মসূচির ছবি পোস্ট করতে খুব একটা দেখা যেত না।
ঘনিষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগহীনতা
ওবায়দুল কাদেরের ঘনিষ্ঠ নেতারা জানান, সরকারের পতনের আগে তিনি প্রতিদিন বিভিন্ন নেতা-কর্মীর সঙ্গে বৈঠক করতেন এবং বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতেন।
কিন্তু গত আড়াই মাসে তার সঙ্গে কোনো নেতা-কর্মীর যোগাযোগ হয়নি।
দলের অন্যান্য নেতারা বিদেশে অবস্থান করলেও ওবায়দুল কাদেরের অবস্থান সম্পর্কে কিছু জানা যাচ্ছে না।
দলে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ
সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
৩১ জুলাই ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে ওবায়দুল কাদের বক্তব্য দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু অন্য নেতারা তাঁকে কথা বলার সুযোগ দেননি। তাঁকে তিরস্কৃত হতে হয়।
এই ঘটনার পর তিনি আরো আড়ালে চলে যান বলে ধারণা করা হয়।
ভারতে অবস্থানকারী নেতাদের মন্তব্য
ভারতে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, ওবায়দুল কাদের প্রায় প্রতিদিন দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতেন।
কিন্তু হঠাৎ তার এই নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনা দলের ভেতরে নানা সন্দেহ এবং জল্পনার জন্ম দিয়েছে।
তাঁর অনুপস্থিতিতে দলের বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় নেতারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে বক্তব্য দিয়ে দলকে একত্রিত রাখার চেষ্টা করছেন।
নেতৃত্বের শূন্যতা এবং দলের চ্যালেঞ্জ
সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের মধ্যে নেতৃত্বের শূন্যতা দেখা দিয়েছে।
দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের অনুপস্থিতিতে দল পরিচালনায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
এ অবস্থায় দলের বাকি নেতারা নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণের চেষ্টা করছেন। কিন্তু বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দলকে আরো দুর্বল করছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং ওবায়দুল কাদেরের ভূমিকা
ওবায়দুল কাদেরের অবস্থান সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য না পাওয়ায় ভবিষ্যতে তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
অনেকেই মনে করছেন, তিনি হয়তো শিগগিরই দলের দায়িত্বে ফিরবেন। অন্যদিকে, কেউ কেউ মনে করেন, তিনি হয়তো আরও দীর্ঘ সময় আত্মগোপনে থাকবেন।
সরকারের পরিবর্তনের পর তার এই আচমকা নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এবং গণমাধ্যমে না আসা নিয়ে দলের বিভিন্ন মহলে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।
দলের অভ্যন্তরে তার অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ ভূমিকা নিয়ে আলোচনার শেষ নেই।
দলীয় নেতারা মনে করছেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে ওবায়দুল কাদেরের উপস্থিতি এবং নেতৃত্ব দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তবে কাদের কোথায় এবং কেন এই দীর্ঘ সময় ধরে আড়ালে আছেন, তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না।
সংক্ষেপে, ওবায়দুল কাদেরের অবস্থান নিয়ে আড়ালে আড়ালে চলছে নানা জল্পনা
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এই আত্মগোপন দলের ভেতর নানা জল্পনা-কল্পনা এবং বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
তিনি কবে প্রকাশ্যে আসবেন, তা নিয়ে দলীয় নেতারা তীব্র প্রতীক্ষা করছেন।