পাঠ্যপুস্তক
,

পাঠ্যপুস্তকে আসছে গণঅভ্যুত্থানের প্রতিফলন, বাদ যাবে রাজনৈতিক নেতাদের উক্তি

নতুন শিক্ষাক্রমে ইতিহাসের পুনর্লিখন এবং পাঠ্যবইয়ের প্রচ্ছদেও আসছে পরিবর্তন

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবেশে, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশসহ প্রায় সব খাতে পরিবর্তনের ঢেউ লাগায় এবার পরিবর্তন আসছে পাঠ্যপুস্তকেও। আগামী বছরের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বইয়ে যুক্ত করা হবে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের প্রতিফলন, বাদ দেয়া হবে রাজনৈতিক নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি ও উক্তি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, ইতিহাসের পুনর্বিন্যাসে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়াস নেয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান জানিয়েছেন, দেশজুড়ে পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় নতুন শিক্ষাক্রমে গণঅভ্যুত্থানের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অবদান সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হবে গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতি

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এক পর্যায়ে সরকার পতনের দাবিতে রূপ নেয়। সেই আন্দোলনে ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতি গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে প্রতিফলিত করেছিল। শিক্ষার্থীরা এসময় দেয়ালে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে গ্রাফিতি আঁকে যা আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠে।

শিক্ষার্থীরা সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, উড়াল সড়ক, মেট্রোরেল, সীমানা প্রাচীরসহ বিভিন্ন স্থানে নিজেদের অর্থে গ্রাফিতি অঙ্কন করে আন্দোলনের চেতনা ফুটিয়ে তোলে। এসব গ্রাফিতিতে উঠে আসে নিহত আন্দোলনকারীদের প্রতিকৃতি, রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি, ঘুষ-দুর্নীতির প্রতিবাদ, বাক-স্বাধীনতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।

এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পুরো বিষয়টি পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরতে কিছু কিছু বইয়ে এই গ্রাফিতিগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বিশেষ করে বাংলা, ইতিহাস এবং বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়ের বইয়ে এ ধরনের গ্রাফিতির ছবি স্থান পাবে।

শেখ হাসিনার উক্তি বাদ দেয়া হচ্ছে

এনসিটিবি চেয়ারম্যান মি. হাসান জানান, বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে শেখ হাসিনার ছবি ও উক্তি শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা সৃষ্টির জন্য অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। তাই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, “পাঠ্যবইয়ের কভার পৃষ্ঠা থেকেই শিক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হওয়া উচিত। কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের উক্তি বা ছবি দেখে যেন শিক্ষার্থীদের মনে রাজনৈতিক ধারণা তৈরি না হয়, সেজন্যই এগুলো বাদ দেয়া হচ্ছে।”

শেখ হাসিনার উক্তির জায়গায় চিরন্তন মূল্যবোধ ও মনীষীদের উদ্ধৃতি যুক্ত করা হবে, যা শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষায় সহায়তা করবে।

ইতিহাসের পুনর্লিখন: সঠিক অবদান থাকবে সবার

বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা প্রধান্য পেয়েছে বলে দাবি রয়েছে। তবে নতুন শিক্ষাক্রমে জিয়াউর রহমানসহ অন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অবদান সঠিকভাবে উপস্থাপন করার ঘোষণা দিয়েছে এনসিটিবি।

এ বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান মি. হাসান বলেন, “ইতিহাসের প্রতিটি ব্যক্তির অবদান নিরপেক্ষভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের যথাযথ ভূমিকা শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরাই আমাদের লক্ষ্য।”

আগামী বছরের পাঠ্যবইয়ে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার উল্লেখ থাকবে বলে তিনি জানান। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য নেতা যেমন মাওলানা ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমেদ, এবং জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীর অবদানও অন্তর্ভুক্ত হবে।

গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের কথা অন্তর্ভুক্তির পরিকল্পনা

জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ এবং ঢাকার উত্তরায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের ছাত্র মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের মৃত্যু আন্দোলনের চেতনায় বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে।

আন্দোলনকালে পুলিশ গুলিতে সাঈদের মৃত্যু ও মুগ্ধের আন্দোলনকারীদের পানি সরবরাহের সময় গুলিবিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি প্রচণ্ড সমালোচনার জন্ম দেয়। এনসিটিবি জানায়, গণঅভ্যুত্থানের এই দুই শহীদকে পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে এই অন্তর্ভুক্তি।

চেয়ারম্যান মি. হাসান বলেন, “এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে তবে এখনও সিদ্ধান্ত আসেনি। যদি মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেয়, তবে শেষ মুহূর্তেও এটি বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব।”

মূল্যবোধ এবং সামাজিক নৈতিকতা অন্তর্ভুক্তির অঙ্গীকার

আগামী বছরের পাঠ্যবইয়ে এমন কোনো বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হবে না, যা কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে আঘাত করে। এনসিটিবি চেয়ারম্যান মি. হাসান বলেন, “আমাদের দেশের ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক কিছুই পাঠ্যবইয়ে রাখা হবে না।”

ধর্মীয় বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলির প্রতি কোনো অবমাননাকর মন্তব্য না থাকা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেন, “কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় যাতে আহত না হয় তা নিশ্চিত করাই আমাদের দায়িত্ব।”

এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাতীয় ঐক্য ও পারস্পরিক সম্মানবোধ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে এনসিটিবি কাজ করছে বলে জানান মি. হাসান।

পুরনো কারিকুলামে ফিরে যাচ্ছে পাঠ্যক্রম

২০২৪ সালের পাঠ্যক্রম তৈরি করা হচ্ছে না ২০২৪ সালের কারিকুলামে, বরং ২০১২ সালের পাঠ্যক্রমকে ভিত্তি করে ২০২৫ সালের জন্য পাঠ্যক্রম তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এনসিটিবির চেয়ারম্যান জানান, “২০২৪ সালের জন্য নির্ধারিত কারিকুলাম বাদ দিয়ে ২০১২ সালের কারিকুলামের ওপর ভিত্তি করে নতুন পাঠ্যপুস্তক প্রণীত হচ্ছে।”

এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে কারণ সাম্প্রতিক পরিবর্তনের ফলে সময় কম থাকায় পুরনো কারিকুলামে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি সহজতর হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা

নতুন শিক্ষাক্রমে যুক্ত হওয়া গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতি এবং রাজনৈতিক নেতাদের উক্তি বাদ দেয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় একটি নতুন অভিজ্ঞতা তৈরি হতে চলেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের নিরপেক্ষ ইতিহাস জানার সুযোগ করে দেবে এবং তাদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।

আগামী বছরের পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের জন্য সত্যিই একটি নতুন মাত্রার সূচনা হতে পারে যেখানে তারা বাংলাদেশি হিসেবে নিজেদের ইতিহাস এবং গৌরবময় সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাবে।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আসা এই নতুন পরিবর্তনকে স্বাগত জানাতে শিক্ষাবিদরা ও বিশ্লেষকরা একমত। শিক্ষার্থীদের প্রকৃত ইতিহাস, মূল্যবোধ এবং জাতিগত ঐক্যকে তুলে ধরে তাদের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার লক্ষ্যে এই পরিবর্তন দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আরও পড়তে পারেন