পাকিস্তান ক্রিকেটের ক্ষেত্রে ‘পরিবর্তনপ্রিয়তা’ এক নতুন বিষয় নয়। অতীতে পাকিস্তান দলকে খেলোয়াড় অদলবদলের ব্যাপারে বেশ সক্রিয় দেখা গেছে। তবে বাংলাদেশে টেস্ট সিরিজে ধবলধোলাই হওয়ার পরও পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) দলের গঠন নিয়ে বড় কোনো পরিবর্তন আনেনি। গুঞ্জন থাকলেও অধিনায়কের পদে শান মাসুদকে বহাল রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আসন্ন সিরিজের প্রথম টেস্টের জন্য ঘোষিত ১৫ সদস্যের দলে ঢুকেছেন দুই নতুন খেলোয়াড়—স্পিনার নোমান আলী এবং পেসার আমের জামাল।
শান মাসুদ: অধিনায়কত্বে আস্থা ও বিতর্ক
বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের ভরাডুবির পর শান মাসুদের অধিনায়কত্ব নিয়ে নানা সমালোচনা চলছিল। টেস্ট ফরম্যাটে তাঁর ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স আশানুরূপ না হলেও তাঁকে অধিনায়ক হিসেবে রাখা নিয়ে বিতর্ক কম ছিল না। শান মাসুদের টেস্ট গড় এখনো ৩০-এর নিচে, মাত্র ২৮.৫৩। তাঁর অধিনায়কত্ব পাওয়া নিয়েও সমালোচনা হয়েছিল, কারণ তাঁর দলে জায়গা নিয়েই প্রশ্ন ছিল অনেকের। বিশেষ করে টানা পাঁচ টেস্টে পরাজয়ের পর অধিনায়কত্ব থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার জল্পনা কল্পনা চলছিল। তবে, বিস্ময়করভাবে পিসিবি তাঁকে আরও একটি সুযোগ দিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ হারের পর কিছুটা সমালোচনা হলেও, সেটি ছিল অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। কিন্তু বাংলাদেশে গিয়ে ধবলধোলাই হওয়ার পর পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে যায়। এই ঘটনার পর শান মাসুদের অধিনায়কত্ব নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছিল, তা কাটিয়ে উঠতে তিনি আরও একটি সুযোগ পেয়েছেন, যা তাঁর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে। এখন দেখার বিষয়, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এই সিরিজে তিনি কীভাবে নিজেকে এবং দলকে প্রমাণ করতে পারেন।
নতুন মুখ: নোমান আলী ও আমের জামাল
বাংলাদেশের বিপক্ষে ১৭ সদস্যের দলের মধ্যে থেকে বাদ পড়েছেন মোহাম্মদ আলী ও কামরান গুলাম। তবে এই দুজনকেই পিসিবির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রাখা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন নির্বাচকেরা। তাঁরা জানিয়েছেন, মোহাম্মদ আলী ও কামরান গুলামকে চ্যাম্পিয়নস কাপ এবং প্রেসিডেন্ট কাপে অংশগ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, নতুন করে দলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন বাঁহাতি স্পিনার নোমান আলী এবং ডানহাতি পেসার আমের জামাল।
নোমান আলী পাকিস্তানের জন্য ইতিমধ্যেই প্রমাণিত একজন খেলোয়াড়। ১৫ টেস্ট খেলে ৪৭ উইকেট সংগ্রহ করা এই স্পিনার সর্বশেষ ২০২৩ সালের জুলাইয়ে টেস্ট খেলেছিলেন। তাঁকে দলে অন্তর্ভুক্ত করার মূল কারণ হিসেবে নির্বাচকেরা জানিয়েছেন, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাঠে বাড়তি স্পিন আক্রমণের প্রয়োজন হতে পারে, যেখানে নোমানকে কার্যকর বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।
পেসার আমের জামালকে দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে চোটগ্রস্ত খুররম শেহজাদের পরিবর্তে। খুররম শেহজাদ বাংলাদেশের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে সাতটি উইকেট শিকার করেছিলেন। তবে চোটের কারণে তাঁকে এই সিরিজ থেকে ছিটকে যেতে হয়েছে। আমের জামাল, যিনি তরুণ এবং উদীয়মান পেসার হিসেবে পরিচিত, তাঁর জন্য এই সুযোগটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইংল্যান্ডের মতো শক্তিশালী দলের বিপক্ষে নিজের প্রতিভা দেখানোর এটি হতে পারে সেরা মঞ্চ।
পাকিস্তানের ব্যর্থতার ধারাবাহিকতা
পাকিস্তানের জন্য সাম্প্রতিক সময়ের পারফরম্যান্স কোনোভাবেই আশা পূরণের মতো নয়। ঘরের মাঠে টানা ১০ টেস্ট জয়হীন থেকে যাচ্ছে দলটি। ২০২২ সালে ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩-০ ব্যবধানে ধবলধোলাইয়ের অভিজ্ঞতা পাকিস্তানের ইতিহাসে আগে কখনো হয়নি। এই টানা ব্যর্থতাই মূলত পাকিস্তানের টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে বাবর আজমকে সরিয়ে দেওয়ার পেছনের কারণ ছিল।
শান মাসুদের অধীনে পাকিস্তান টেস্ট দলের যাত্রা শুরু হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ দিয়ে, যেখানে ৩-০ তে পাকিস্তান হেরে যায়। যেহেতু এই সিরিজটি অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে হয়েছিল, তাই সমালোচনা কিছুটা কম ছিল। তবে বাংলাদেশের বিপক্ষে ধবলধোলাইয়ের পর সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করে। শান মাসুদের নেতৃত্বে দলের ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণে তাঁর ওপর চাপ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।
পাকিস্তান ক্রিকেটে অধিনায়কত্ব সবসময়ই একটি জটিল এবং চাপপূর্ণ দায়িত্ব। শান মাসুদের জন্যও তা ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু তাঁকে আরও একটি সুযোগ দেওয়ার পেছনে টেস্ট দলের কোচ জেসন গিলেস্পির পরামর্শ বড় ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গিলেস্পি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, দলের একগুঁয়ে পরিবর্তনের বদলে কিছুটা স্থিরতা এবং ধারাবাহিকতা দলকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। এজন্যই হয়তো দল নির্বাচনে বড় কোনো কাটাছেঁড়া করা হয়নি।
চ্যাম্পিয়নস কাপ এবং অনুশীলন ক্যাম্প
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আসন্ন সিরিজের প্রথম টেস্টের জন্য ঘোষিত দলে স্থান পাওয়া ক্রিকেটারদের চ্যাম্পিয়নস কাপের প্লে-অফ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, যাতে তাঁরা মুলতানে অনুষ্ঠিতব্য ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হতে যাওয়া অনুশীলন ক্যাম্পে অংশ নিতে পারেন। এই ক্যাম্প ১ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে এবং এরপরই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্টের জন্য দল প্রস্তুতি নেবে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্টটি শুরু হবে ৭ অক্টোবর।
এই অনুশীলন ক্যাম্প এবং এর আগের ঘরোয়া টুর্নামেন্টগুলোতে পারফর্ম করা ক্রিকেটারদের মনোবল বাড়াতে এবং সেরা ফর্মে ফিরিয়ে আনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। পাকিস্তানের জন্য ঘরের মাঠে এই সিরিজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ের টানা ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠার জন্য।
পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ পথচলা
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ পাকিস্তানের জন্য একটি বড় পরীক্ষা হতে চলেছে। ঘরের মাঠে তারা দীর্ঘদিন ধরেই জয় খুঁজে পাচ্ছে না। এই ব্যর্থতার ধারা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য শান মাসুদের নেতৃত্বে দলকে একটি সুনির্দিষ্ট দিশা খুঁজে বের করতে হবে। পিসিবির নতুন নির্বাচকমণ্ডলী এবং কোচিং স্টাফও দলের ওপর আস্থা রেখেছে। এখন দলের পারফরম্যান্সের ওপর নির্ভর করছে, এই আস্থা কতটা সঠিক।
দলগতভাবে পাকিস্তানের ব্যাটিং এবং বোলিং উভয় বিভাগেই উন্নতি করতে হবে। বিশেষ করে দলে তরুণদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে কোচ জেসন গিলেস্পির পরামর্শ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টেস্ট ক্রিকেটে ধারাবাহিকতা এবং স্থিরতা খুব গুরুত্বপূর্ণ, এবং পাকিস্তান দল সেই ধারাবাহিকতা অর্জন করার চেষ্টায় রয়েছে।
ইংল্যান্ডের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিপক্ষে পাকিস্তানের টেস্ট সিরিজ কেমন হবে, তা এখন সময়ই বলবে।