,

পাকিস্তানের করাচি থেকে বাংলাদেশে সরাসরি কন্টেইনারবাহী জাহাজ: নতুন বাণিজ্য যুগের সূচনা?

স্বাধীনতার পর করাচি থেকে সরাসরি প্রথম জাহাজ চট্টগ্রামে

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের করাচি থেকে সরাসরি একটি কন্টেইনারবাহী জাহাজ এসে ভিড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে।

গত ১৩ই নভেম্বর, ‘এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং’ নামের জাহাজটি করাচি থেকে রওনা দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে।

জাহাজটি দুবাই থেকে করাচি হয়ে ইন্দোনেশিয়ায় যাওয়ার পথে বাংলাদেশে কন্টেইনার আনলোড করে।

এই সরাসরি জাহাজ চলাচল নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনার পাশাপাশি গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আগ্রহ দেখা দিয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক জানিয়েছেন, “জাহাজটি করাচি থেকে সোজা চট্টগ্রাম এসেছে, যা স্বাধীনতার পর প্রথম।”

এই জাহাজ আগমনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের শীতল সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে বলে মত বিশ্লেষকদের।

এতদিন পর কেন সরাসরি জাহাজ?

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্য দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল।

পরবর্তীতে বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনরায় শুরু হলেও পাকিস্তান থেকে সরাসরি জাহাজ চট্টগ্রামে আসত না।

সাধারণত, করাচি থেকে পণ্য সিঙ্গাপুর বা শ্রীলঙ্কার বন্দর হয়ে বাংলাদেশে আসত।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দুই দেশের সম্পর্ক আরও শীতল হয়ে পড়ে।

তখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে পাকিস্তানের অনেক পণ্যকে “লাল তালিকায়” রাখে।

এতে পাকিস্তান থেকে আমদানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।

কিন্তু অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তানের অনুরোধে গত ২৯শে সেপ্টেম্বর ওই লাল তালিকা থেকে সব পণ্য বাদ দেওয়া হয়।

এরপরই করাচি থেকে সরাসরি জাহাজ চট্টগ্রামে এসে পৌঁছায়।

পাকিস্তান হাই কমিশন এই ঘটনাকে “দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বড় পদক্ষেপ” হিসেবে অভিহিত করেছে।

তারা বলেছে, এই সরাসরি রুট বাণিজ্যিক কার্যক্রম সহজ করবে এবং উভয় দেশের জন্য নতুন ব্যবসার সুযোগ তৈরি করবে।

কী কী পণ্য এসেছে এই জাহাজে?

চট্টগ্রাম কাস্টমস জানিয়েছে, জাহাজটি ৩৭০টি কন্টেইনার নিয়ে এসেছিল, যার মধ্যে পাকিস্তান থেকে সরাসরি এসেছে ২৯৭টি।

বাকি কন্টেইনারগুলো দুবাই থেকে লোড করা হয়েছে।

পাকিস্তান থেকে আসা পণ্যের মধ্যে ছিল ফ্রেবিকস, সোডা অ্যাশ, ডলোমাইট, চুনাপাথর, পেঁয়াজ, ম্যাগনেশিয়াম কার্বোনেট এবং গাড়ির যন্ত্রাংশ।

সব মিলিয়ে এসব পণ্যের ওজন ছিল ছয় হাজার ৩৩৭ টন।

এর মধ্যে ১১৫টি কন্টেইনারে সোডা অ্যাশ এবং ৪৬টি কন্টেইনারে ডলোমাইট ছিল।

কিছু কন্টেইনারে ছিল টেক্সটাইল শিল্পের কাঁচামাল, কাঁচের তৈরি সামগ্রী এবং প্রসাধনী।

৪২টি কন্টেইনারে পেঁয়াজ এবং ১৪টি কন্টেইনারে আলু ছিল।

দুবাই থেকে আসা কন্টেইনারে খেজুর, মার্বেল ক্লক, কপার ওয়্যার, জিপসাম এবং একটি কন্টেইনারে অ্যালকোহল জাতীয় পণ্য ছিল।

কেন এতদিন সরাসরি যোগাযোগ ছিল না?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরাসরি জাহাজ চলাচল না হওয়ার পেছনে কয়েকটি বড় কারণ ছিল।

প্রথমত, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে পণ্যের চাহিদা সীমিত হওয়ায় বড় জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রামে আসত না।

দ্বিতীয়ত, শ্রীলঙ্কা বা সিঙ্গাপুরের মতো তৃতীয় কোনো বন্দরের মাধ্যমে পণ্য পরিবহনের প্রচলন ছিল।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন,

“পাকিস্তান থেকে খোলাভাবে পণ্য আগেও আসত। তবে সরাসরি কন্টেইনারে করে আসাটা এই প্রথম।”

তিনি আরও বলেন, “এটি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। সরাসরি যোগাযোগ খরচ এবং সময় দুটোই কমাবে।”

সময় ও খরচ কমানোর সম্ভাবনা

পাকিস্তানের করাচি থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব প্রায় ২ হাজার ৬১২ নটিক্যাল মাইল।

এর আগে পণ্য পরিবহনে শ্রীলঙ্কা বা সিঙ্গাপুর হয়ে আসায় অতিরিক্ত সময় ও খরচ লাগত।

কিন্তু সরাসরি জাহাজ চলাচলে ২০-২৫ দিনের পরিবর্তে এখন মাত্র ১০ দিনের মধ্যেই পণ্য পৌঁছানো সম্ভব।

পোশাক ব্যবসায়ী সৈয়দ নবীদ শাহ বলছেন, “এভাবে সরাসরি যোগাযোগ হলে উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের ক্ষতি কম হবে।

সময়মতো পণ্য পৌঁছে যাবে, যা ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করবে।”

আরেক ব্যবসায়ী সৌম্য সামু জানান, “আগে সময়মতো পণ্য না পৌঁছানোর কারণে অনেক ক্ষতি হতো।

এখন দ্রুত পণ্য আসায় ব্যবসার সুযোগ বাড়বে।”

দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উষ্ণতা

করাচি থেকে সরাসরি জাহাজ আসা শুধু একটি বাণিজ্যিক ঘটনা নয়, এটি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উষ্ণতার ইঙ্গিত বহন করে।

সম্প্রতি জাতিসংঘে অধ্যাপক ইউনূস এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের বৈঠকের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সহযোগিতা আরও জোরদার হয়েছে।

পাকিস্তানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ১৭ হাজার কন্টেইনার এসেছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে গেছে ১৬ হাজার কন্টেইনার।

ভবিষ্যৎ কী?

এই সরাসরি জাহাজ চলাচল উভয় দেশের জন্যই লাভজনক হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

পণ্য পরিবহনের সময় ও খরচ কমার পাশাপাশি নতুন বাণিজ্য সুযোগও তৈরি হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে সরাসরি যোগাযোগ বজায় রাখতে হলে উভয় দেশকে ব্যবসায়িক পরিবেশ আরও সহজ করতে হবে।

সরকারি নীতিমালা এবং কাস্টমস প্রক্রিয়ায় আরও স্বচ্ছতা আনা প্রয়োজন।

এই জাহাজ চলাচল দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে, এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট মহলের।

আরও পড়তে পারেন