খালেদা জিয়া
,

নির্বাচন নিয়ে স্পষ্টতার অভাবে বিএনপির অসন্তোষ, সমর্থন নিয়ে প্রশ্ন

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি শুরু থেকেই সমর্থন জানিয়েছে।

তবে নির্বাচন নিয়ে ‘সুস্পষ্ট’ সময়সীমা না পাওয়ায় দলটির নেতারা ক্রমাগত অসন্তোষ প্রকাশ করছেন।

রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির মুখে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা সম্ভাব্য সময়সীমা ঘোষণা করেন।

প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় ২০২৫ সালের শেষ থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের ইঙ্গিত দেওয়া হয়।

কিন্তু সেই ঘোষণায় ‘অস্পষ্টতার’ অভিযোগ তুলে বিএনপি হতাশা প্রকাশ করেছে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা এবং তার প্রেস সচিবের বক্তব্যকে ‘পরস্পরবিরোধী’ বলেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, “এ ধরনের বক্তব্য বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে এবং রাজনৈতিক দলগুলো সুস্পষ্ট ঘোষণা প্রত্যাশা করে।”

তিনি প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ এবং তার প্রেস সচিবের বক্তব্যের মধ্যে সাংঘর্ষিক দিক তুলে ধরেন।

এর আগে, অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়েও বিএনপি নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

তারা মনে করেন, এসব বক্তব্যে বিএনপি’কে ইঙ্গিত করে একধরনের রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এই অসন্তোষকে অমূলক বলে দাবি করেন।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সরকারের কোনো পক্ষের সঙ্গে বিরোধী দলগুলোর আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়নি।”

তিনি আরও বলেন, “নির্বাচন, সংস্কার এবং বিচার একটি জটিল প্রক্রিয়া, যা সময়সাপেক্ষ।”

সরকারের পক্ষ থেকে বারবার উল্লেখ করা হচ্ছে, সময় নির্ধারণের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।

তবে সরকারের অবস্থান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্যের অভাবে বিএনপি এখনো তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধায় আছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকারের বক্তব্যে কৌশল এবং বিএনপির বক্তব্যে শঙ্কার মিশ্রণ দেখা যাচ্ছে।

এমন অবস্থায়, নির্বাচন নিয়ে সংশয় কাটাতে দুই পক্ষের স্বচ্ছ আলোচনা প্রয়োজন বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

বিএনপি নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্য

বিএনপির নেতারা সম্প্রতি একাধিক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

বৃহস্পতিবার মানিকগঞ্জ, নরসিংদী এবং মুন্সিগঞ্জের কর্মশালায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তারেক রহমান সরকারকে দুর্বল বলে উল্লেখ করেন।

তারেক রহমান বলেন, “দুর্বল এবং জনসমর্থনহীন সরকার ক্ষমতায় থাকলে দেশের সম্পদ লুটপাটের সুযোগ তৈরি হয়।”

তিনি দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে উল্লেখ করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।

বিএনপির প্রশিক্ষণ কর্মশালাগুলো দলীয় নেতাকর্মীদের মনোবল বাড়াতে এবং রাজনৈতিক কৌশল ঠিক করতে আয়োজিত হচ্ছে।

এর আগে, প্রধান উপদেষ্টার সময়সীমা সংক্রান্ত বক্তব্য নিয়ে সরব হন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা এবং তার প্রেস সচিবের বক্তব্য পরস্পরবিরোধী।”

মির্জা ফখরুল প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যকে ‘ধোঁয়াশাপূর্ণ’ আখ্যা দেন।

তিনি অভিযোগ করেন, সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থার জায়গা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে।

বিএনপি নেতারা মনে করছেন, নির্বাচন নিয়ে স্পষ্ট ঘোষণা না থাকলে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়বে।

অন্যদিকে, সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টা এই সমালোচনাকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে অভিহিত করেছেন।

বিজয় দিবসে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে ‘সংস্কারের প্রয়োজনে সময় বাড়তে বা কমতে পারে’ বলার পর বিএনপির উদ্বেগ আরও বেড়েছে।

তারেক রহমান এবং মির্জা ফখরুলের বক্তব্যে সরকারের ভূমিকা নিয়ে হতাশার সুর প্রকাশ পায়।

তারা একাধিকবার বলেছেন, দেশের জনগণ সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে এ বিষয়ে স্বচ্ছ হওয়া উচিত।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপি তাদের অবস্থান সুসংহত করতে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করছে।

তারা মনে করেন, বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার আগে সরকারকে রাজনৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে।

এদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাতে প্রস্তুত।

অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই, বিএনপির নেতাদের বক্তব্য রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়িয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হতে পারে।

আস্থা ও সমর্থনের প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান

বিএনপি প্রথম থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন জানালেও সাম্প্রতিক বক্তব্যে আস্থার ঘাটতি প্রকাশ পেয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ছয়টি কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ শুরু করে।

এই কমিশনগুলোর মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন অন্যতম।

তবে এই কমিশনের প্রতিবেদন আসার আগেই পুরনো আইনের অধীনে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়।

বিএনপি মনে করছে, নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম স্পষ্ট না হওয়ায় তাদের আস্থার জায়গায় ফাটল ধরেছে।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া সরকারের দায়িত্ব।”

তিনি দাবি করেন, সরকার সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত না দিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।

তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভিন্নমত প্রকাশ করেন।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার। এ বিষয়ে অবস্থান অপরিবর্তিত।”

তার ভাষ্য অনুযায়ী, জনগণের মধ্যে দ্বিধা দূর করতে সরকারের স্বচ্ছতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন।

বিএনপির আরেক নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা চাই সরকার সঠিকভাবে কাজ করুক এবং নির্বাচনের আয়োজন করুক।”

তিনি দাবি করেন, তাদের সমালোচনা সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার জন্য এবং এটাকে সমর্থনবিরোধী বলা ঠিক হবে না।

তবে সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বিএনপির এই বক্তব্যকে রাজনৈতিক কৌশল বলে অভিহিত করেছেন।

তার মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বিএনপির আস্থা রয়েছে, তবে তারা রাজনৈতিক চাপ বাড়াতে বিভিন্ন বক্তব্য দিচ্ছে।

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ নিয়ে বিতর্ক

বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, “২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে।”

তবে, এর সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, “সংস্কারের প্রক্রিয়ায় সময় বাড়তেও বা কমতেও পারে।”

এই মন্তব্য বিএনপির মধ্যে নতুন করে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।

পরদিন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, “২০২৬ সালের ৩০শে জুনের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে।”

বিএনপির নেতারা এই বক্তব্যকে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করেছেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, “এমন পরস্পরবিরোধী বক্তব্য জনগণের মধ্যে আরও সংশয় তৈরি করবে।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক তারানা বেগম বলেছেন, “সরকার কৌশলী ভাষায় সময়সীমা উল্লেখ করছে, যা ধোঁয়াশা বাড়াচ্ছে।”

তার মতে, স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট সময়সীমা না থাকায় রাজনৈতিক দলগুলো উদ্বিগ্ন।

অন্যদিকে, অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ মনে করেন, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে সময়সীমা যথেষ্ট স্পষ্ট ছিল।

তিনি বলেন, “সরকার যদি এই সময়সীমার মধ্যেই নির্বাচন আয়োজন করে, তাহলে বিএনপির এই শঙ্কার অবসান হবে।”

বিএনপির কৌশল নাকি শঙ্কা?

বিএনপির সাম্প্রতিক বক্তব্যকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখছেন অনেক বিশ্লেষক।

অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, “বিএনপি সম্ভবত মনে করছে, তাদের সময়মতো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে জনসমর্থনে প্রভাব পড়তে পারে।”

তিনি আরও বলেন, “জনসমর্থন ধরে রাখতে বিএনপি এখন সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে।”

সরকার পতনের পরের দুই মাসে দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে এক হাজারের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় বিএনপি।

বিশ্লেষকদের মতে, দলের অভ্যন্তরীণ চাপও নেতাদের বক্তব্যে প্রতিফলিত হচ্ছে।

অন্যদিকে, অধ্যাপক তারানা বেগম মনে করেন, “দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে বিএনপির অবস্থান দুর্বল হতে পারে।”

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে।

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, “আস্থার সংকট না থাকলেও মতভিন্নতা স্বাভাবিক।”

তিনি মনে করেন, প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন এই ভিন্নতা নিরসনে কাজ করবে।

তবে, বিএনপির নেতারা তাদের বক্তব্যে বারবার সরকারের স্বচ্ছতার অভাবের কথা উল্লেখ করেছেন।

এই অবস্থায়, বিএনপির বক্তব্য রাজনৈতিক কৌশল নাকি সত্যিকার শঙ্কা—এ নিয়ে বিতর্ক চলছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দুই পক্ষের মধ্যে সুস্পষ্ট আলোচনা ছাড়া এই বিতর্ক সহজে মিটবে না।

আরও পড়তে পারেন