আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত এবং আইসিটি আইনে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে উত্তাপ বেড়েছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে।
বিশেষ করে, জুলাই মাসে গণঅভ্যুত্থানের সময়কার সহিংসতার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে ব্যাপক সমালোচনা চলছে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দলীয়ভাবে আইসিটি আইনে দোষী সাব্যস্ত হলে আওয়ামী লীগ আজীবন নির্বাচন থেকে অযোগ্য হতে পারে।
বাংলাদেশের নির্বাচনি আইন, বিশেষত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও), কোনো দল নিষিদ্ধ হলে তাদের নিবন্ধন বাতিলের সুযোগ দেয়।
তবে দল নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে হলে আদালতের রায় কিংবা নির্বাহী আদেশ প্রয়োজন।
এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় নিষিদ্ধের কোনো নির্দেশনা আসেনি।
তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তের ওপর নির্ভর করছে দলটির নির্বাচনে অংশগ্রহণের ভবিষ্যৎ।
আইসিটি আইনে দোষী সাব্যস্ত হলে ব্যক্তি বা দল—কেউই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।
নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে দুটি প্রধান আইনি বাধার মুখোমুখি হতে হতে পারে।
প্রথমত, ব্যক্তিগত পর্যায়ে নেতাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ।
দ্বিতীয়ত, দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত করার সম্ভাবনা।
নির্বাচন ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম বলেন, “দলীয়ভাবে দোষী প্রমাণিত হলে নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করতে পারে।”
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বৈধ রয়েছে।
এর মানে, আইনি প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্য।
নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সংস্কার কমিশনের বক্তব্য ও অবস্থান
নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদারের সাম্প্রতিক বক্তব্য বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার রংপুরে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আইনগতভাবে কোনো দল অযোগ্য না হলে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকা উচিত।”
তার এই বক্তব্যের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।
ছাত্র সংগঠনগুলোর দাবি, আওয়ামী লীগ গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে দোষী।
তারা দলটির নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগকে “জন-আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে” বলে অভিহিত করেছে।
তবে শুক্রবার রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে মজুমদার তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেন।
তিনি বলেন, “কোনো দলকে বাদ দেওয়া বা সুযোগ দেওয়া নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারে পড়ে না।”
তার মতে, দল নিষিদ্ধ বা অযোগ্য হলে তা আদালত বা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, “আমরা চাই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন।”
তবে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের শর্ত মেনে চলতে গিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত দলকে সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত।
কমিশনের বক্তব্যের সপক্ষে কিছু রাজনৈতিক দল মত দিলেও ছাত্র আন্দোলনকারীদের তীব্র আপত্তি রয়েছে।
তাদের মতে, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অভিযোগের সুষ্ঠু বিচার না হলে তাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটির অবস্থান
আওয়ামী লীগের নির্বাচন অংশগ্রহণের বিষয়ে সবচেয়ে কড়া অবস্থান নিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানে হাজার হাজার মানুষ হতাহত হওয়ার পেছনে দলটির ভূমিকা নিয়ে তারা সরাসরি অভিযোগ তুলেছে।
সংগঠনটির আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, “গণহত্যার সঙ্গে জড়িত দলটির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কোনো বৈধতা থাকতে পারে না।”
তারা দাবি করছে, আওয়ামী লীগের যেকোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, বিশেষত নির্বাচনে অংশগ্রহণ, জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এক বিবৃতিতে জানায়, “আওয়ামী লীগের বিচার ছাড়া তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া গণতন্ত্রের প্রতি চরম অবজ্ঞা।”
জাতীয় নাগরিক কমিটিও একই সুরে কথা বলছে।
তারা মনে করে, গণহত্যার বিচার না হলে ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আরও জটিল হয়ে পড়বে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী বলেছেন, “এটি শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি নৈতিক বিষয়ও।”
তাদের দাবি, আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী দলগুলো গণতন্ত্রের মূল কাঠামো ভেঙে দিয়েছে।
এই অবস্থায় তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ রাজনৈতিক শুদ্ধতার বিরুদ্ধে যাবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং নাগরিক কমিটি দেশের বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনগণের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে।
তাদের লক্ষ্য, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনকে আরও সুসংহত করা।
তারা বলছে, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের সুষ্ঠু বিচারের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে দূরে থাকা উচিত।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত ও সম্ভাব্য বিচার
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
প্রাথমিক তদন্তে দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় দুই শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে।
ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, “তদন্ত চলছে এবং অভিযোগের ভিত্তিতে চার্জ গঠন করা হবে।”
এই অভিযোগগুলোতে দলীয় নেতাদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সহযোগী ১৪ দলের নেতাদেরও নাম রয়েছে।
তদন্তের মূল ফোকাস দলটির গত ১৫ বছরের শাসনামলে গুম, খুন, এবং সহিংসতার ঘটনাগুলো।
ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে নেতাদের বিচারের পাশাপাশি দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগকে অভিযুক্ত করার সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
যদি দল হিসেবে আওয়ামী লীগ দোষী সাব্যস্ত হয়, তবে তারা চিরতরে রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে অযোগ্য হতে পারে।
তবে প্রসিকিউটররা এখনই দলীয় বিচার প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তারা বলছেন, “বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরেই এটি পরিষ্কার হবে।”
গণহত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হলে আওয়ামী লীগের অনেক নেতার আজীবন কারাদণ্ড হতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, দলীয় বিচারের ক্ষেত্রে এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা হতে পারে।
যদি দলীয়ভাবে অপরাধ প্রমাণিত হয়, তবে এটি শুধু আওয়ামী লীগের জন্য নয়, দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হবে।
রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ শুধু তাদের বিচার বা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগের ওপর নির্ভর করছে না।
এটি নির্ভর করছে গণতন্ত্র রক্ষার প্রচেষ্টার ওপরও।
তাদের বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো মনে করে, গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হলে আওয়ামী লীগকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
আওয়ামী লীগকে নির্বাচন থেকে বাদ দিলে দেশের রাজনৈতিক সংকট আরও তীব্র হতে পারে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির দাবির বিপরীতে কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনেই দীর্ঘমেয়াদে শান্তি আসতে পারে।
তারা বলছেন, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দলীয় বিচার এবং গণতন্ত্রের পুনর্গঠন দুইটিই একসঙ্গে চলতে পারে।
তবে এ বিষয়ে এখনো স্পষ্ট কোনো রূপরেখা তৈরি হয়নি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় দলকে বাদ দেওয়া হলে তার প্রভাব বহুদূরপ্রসারী হতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে দেশের জনগণ এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিভক্তি বাড়ছে।
গণতন্ত্র, আইন, এবং নৈতিকতার দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখন এক চূড়ান্ত পরীক্ষা অতিক্রম করছে।