নবীকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে উত্তেজিত জনতা ও সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনা চলছে
ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার কাদিরদী ডিগ্রী কলেজের একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রকে নবীকে নিয়ে ফেসবুকে কটূক্তিমূলক মন্তব্য করার অভিযোগে সেনাবাহিনী হেফাজতে নেওয়ার পর এখন জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। দুই দিন আগে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটি স্থানীয় সাংবাদিক, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কিশোরটি তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করলেও উত্তেজিত জনতা তাকে মারধর করে এবং তার উপর চাপ সৃষ্টি করে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, কিশোরটি দাবি করেছে যে, ফেসবুকে ওই মন্তব্য তার করা নয়, বরং তার পুরনো ফেসবুক আইডি হ্যাক করা হয়েছে এবং সেখান থেকেই কেউ কটূক্তিমূলক মন্তব্য পোস্ট করেছে। এমন পরিস্থিতিতে কলেজের শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় লোকজনের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে।
অধ্যক্ষ নুরুজ্জামান মোল্যা জানান, উত্তেজিত জনতা যখন কিশোরটির উপর হামলা চালানোর চেষ্টা করে, তখন তাকে কলেজের কক্ষে আশ্রয় দেওয়া হয়। তবে পরিস্থিতি এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে, অধ্যক্ষের পক্ষে তাকে রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছিল না। জনতার তীব্র চাপের মুখে অবশেষে কিশোরটিকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়।
কিশোরের ওপর অভিযোগ ও ঘটনার সূত্রপাত
গত সোমবার সকালে কাদিরদী ডিগ্রী কলেজে উপস্থিত হওয়ার পরপরই কিছু শিক্ষার্থী অভিযোগ তোলে যে, ওই কিশোর ফেসবুকে নবীকে নিয়ে কটূক্তিমূলক মন্তব্য করেছে। স্থানীয় সাংবাদিক মফিজুর রহমান শিপনের বক্তব্য অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমেই বৃদ্ধি পায় এবং এটি এক ধরনের “মব মেন্টালিটি”তে রূপ নেয়।
কিশোরটি এই অভিযোগ অস্বীকার করে জানায়, তার কাছে অ্যান্ড্রয়েড ফোন নেই এবং সে ফেসবুকে এমন কিছু লেখেনি। তবুও উত্তেজিত জনতা তাকে কলেজ ক্যাম্পাসেই ঘিরে ধরে মারধর শুরু করে। অধ্যক্ষ নুরুজ্জামান মোল্যা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তাকে নিজের কক্ষে আশ্রয় দেন। তবে ছাত্র ও স্থানীয়দের মধ্যে উত্তেজনা এতটাই তীব্র ছিল যে, অধ্যক্ষ তাকে রক্ষা করতে হিমশিম খেতে থাকেন।
“আমি দেখলাম ছাত্রদের মধ্যে কানাঘুষা চলছে, এবং কিছু শিক্ষার্থী কিশোরটিকে মারার জন্য উদ্যত হয়ে আছে। ওই মুহূর্তে পরিস্থিতি বুঝে আমি তাকে আমার কক্ষে নিয়ে এলাম,” জানান অধ্যক্ষ মোল্যা। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই জনতা তার কক্ষ ঘিরে ফেলে এবং দরজা ভেঙে কিশোরটিকে বের করার চেষ্টা করে।
কিশোরটি জানায় যে, তার পুরনো ফেসবুক আইডি থেকে ওই মন্তব্য করা হয়েছে, কিন্তু সে কোনোভাবেই এই বিষয়ে জড়িত নয়। তবে জনতা তার এই বক্তব্য বিশ্বাস না করে তাকে “মব জাস্টিস” বা গণপিটুনির হুমকি দিতে থাকে। পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হতে থাকে এবং দ্রুত এর সমাধান না হলে মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারতো।
সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ও উত্তেজিত জনতা
সাতৈর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রাফিউল আলম জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় স্থানীয় প্রশাসনের কাছে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীকে ডাকা হয়। অধ্যক্ষ মোল্যা জানান যে, ক্ষিপ্ত জনতার একটাই দাবি ছিল—এই কিশোরকে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হোক, যাতে তারা নিজেরাই “ন্যায়বিচার” করতে পারে।
“মানুষ বলছিলো, আমাদের কাছে ছেড়ে দিন, আমরা ওকে মেরে ফেলবো,” বলেন চেয়ারম্যান আলম।
শেষ পর্যন্ত, জনতার চাপের মুখে তিনটি শর্তের ভিত্তিতে কিশোরটিকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। প্রথম শর্ত ছিল, ওই কিশোরকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করতে হবে যাতে সে আর কোথাও পড়তে না পারে। দ্বিতীয় শর্তে একজন শিক্ষকের শোকজ করা হয় যিনি কিশোরটির পক্ষে কিছু কথা বলেছিলেন। তৃতীয় শর্তে একজন আলেম এনে পরিস্থিতির তাৎক্ষণিক বিচার করতে হবে।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ও সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা
সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে কিশোরটিকে উদ্ধার করে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে নেয়। তবে এই উদ্ধার প্রক্রিয়ার কিছু ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে দেখা যায় যে, সেনাসদস্যরা কিশোরটির চোখ বেঁধে তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে যাচ্ছে এবং মাঝে মাঝে তাকে লাঠি ও বুট দিয়ে আঘাত করছে।
ভিডিওগুলো সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকেই সেনাবাহিনীর এই আচরণের তীব্র সমালোচনা করছেন। ভিডিওতে কিছু জায়গায় জনসাধারণকে বলতে শোনা যায়, “পায়ে মারেন!” এবং “পাঁচ মিনিটের জন্য আমাদের হাতে দিন।” এসব পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর সদস্যরা কিশোরটিকে পিটিয়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।
সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, কেন সেনাবাহিনী এমন আচরণ করলো এবং কেন তারা জনগণের চাপের মুখে এই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। অনেকেই সেনাবাহিনীর আচরণের সমালোচনা করে লিখেছেন, “দেশ রক্ষার বাহিনী এভাবে একজন কিশোরকে মারধর করছে, যা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না।”
একজন ব্যবহারকারী মন্তব্য করেছেন, “সেনাবাহিনী কীভাবে বুট দিয়ে কিশোরকে আঘাত করতে পারে? এধরনের আচরণ দেশের সংখ্যালঘুদের জন্য বিপজ্জনক ইঙ্গিত দেয়।” অন্য একজন লিখেছেন, “সেনাবাহিনীর এই আচরণের যথাযথ তদন্ত হওয়া উচিত এবং দায়ী সদস্যদের বিচার হওয়া প্রয়োজন।”
তদন্ত চলছে এবং কিশোরের বর্তমান অবস্থা
কিশোরটিকে সেনাবাহিনীর হেফাজত থেকে পুলিশে সোপর্দ করা হয় এবং বর্তমানে সে ফরিদপুরের জেল হাজতে রয়েছে। বোয়ালমারী থানার ওসি মো. গোলাম রসুল জানিয়েছেন যে, তাকে ৫৪ ধারায় আটক করা হয়েছে, যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে পুলিশ কোনো ব্যক্তি সন্দেহভাজন হলে তাকে গ্রেপ্তার করতে পারে।
বর্তমানে এই ঘটনার তদন্ত চলছে এবং পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত মন্তব্য করা যাবে না।
কিশোরটির পরিবারও এই ঘটনার পর থেকে আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। স্থানীয় চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, কিশোরটির গ্রাম ঘোষপুরে উত্তেজিত জনতা মিছিল ও মানববন্ধনের আয়োজন করেছে এবং তার ফাঁসির দাবি তুলেছে।
এছাড়াও স্থানীয়রা জানিয়েছে, কিশোরটির বাড়ির সামনে পুলিশ ও স্থানীয় জনতা মিলে পাহারা দিচ্ছে যাতে কেউ তাদের উপর হামলা চালাতে না পারে।
এর আগেও একই অভিযোগ ও অতীতের ঘটনা
এই ঘটনাটি কোনো প্রথম ঘটনা নয়। মাত্র পাঁচ মাস আগেও একই অভিযোগে কিশোরটিকে আটক করা হয়েছিল। তখনও ফেসবুকে নবীকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যের অভিযোগে তাকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল, তবে তখন তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি এবং তাকে কয়েকদিন পর জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
সেই সময়ও এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল এবং স্থানীয় জনগণ কিশোরটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করেছিল। তবে তখন প্রশাসন কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা না নেওয়ায় বর্তমান পরিস্থিতি আরও গুরুতর রূপ ধারণ করেছে বলে অনেকেই মনে করছেন।
স্থানীয় চেয়ারম্যান ইমরান হোসেন নবাব জানান, গতবার পুলিশ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এবার তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, বিষয়টি আইন অনুযায়ী বিচার হবে এবং প্রকৃত অপরাধী সনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার আশঙ্কা
এ ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্মীয় এবং মানবাধিকার সংগঠন ঘটনাটির নিন্দা জানিয়ে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। অনেকে বলেছেন, এ ধরনের আচরণ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়াতে পারে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং আইনজীবী সমাজ থেকে এই ঘটনায় সেনাবাহিনীর প্রতি নিরপেক্ষ তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের বিচার দাবি করা হয়েছে।
এদিকে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ও প্রশাসন জনগণকে শান্ত থাকতে এবং আইনকে নিজেদের হাতে তুলে না নিতে আহ্বান জানিয়েছেন।