বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এ বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৬৩ জন মারা গেছেন, যার মধ্যে শুধু সেপ্টেম্বরেই মৃত্যু হয়েছে ৮০ জনের। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, অক্টোবর মাসে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম ৯ মাসে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে সেপ্টেম্বর মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৮ হাজারের বেশি মানুষ, যা এডিস মশার দ্রুত বিস্তারের ফলাফল। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশার বংশবিস্তার বাড়ার পাশাপাশি দেশের স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য বিভাগের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমানো সম্ভব হচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে দেখা যায়, গত মাসে প্রতি সপ্তাহে ডেঙ্গু সংক্রমণের হার আগের সপ্তাহের তুলনায় ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। গত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে সংক্রমণের হার ছিল ২৪ শতাংশ, যা মাসের প্রথম সপ্তাহের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি।
মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে
সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। মাসের শুরুতে প্রথম সাত দিনে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১১ জন, আর শেষ সাত দিনে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৩০ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর বাড়তি মৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার একটি জরিপের মাধ্যমে জানিয়েছেন, সেপ্টেম্বরে এডিস মশার বিস্তার ১৫ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
বর্ষাকাল ও ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বছরের বৃষ্টিপাতের ধরণ ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। সাধারণত জুলাই মাসে বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হয়, তবে এ বছর জুলাইতে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে। এরপর আগস্ট মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৬ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়, যা এডিস মশার বংশবিস্তারকে ত্বরান্বিত করেছে।
বৃষ্টি ও ডেঙ্গুর সংক্রমণের মধ্যে একটি সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। যুক্তরাজ্যের কেইল ইউনিভার্সিটির এপিডেমিওলজি বিভাগের প্রভাষক নাজমুল হোসেনের গবেষণায় দেখা গেছে, একটি মাসে বেশি বৃষ্টিপাত হলে পরবর্তী মাসে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ১৭ শতাংশ বেড়ে যায়।
অক্টোবর মাসেও বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার বাইরে এবং সারা দেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সমন্বয়ের অভাব ও স্থানীয় সরকারের অব্যবস্থাপনা
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কীটতত্ত্ববিদেরা মনে করেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা বড় একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা ডেঙ্গুর লার্ভা জরিপ করে স্থানীয় সরকারকে সে সম্পর্কে অবহিত করে। তবে এ বছর বর্ষার আগের জরিপ ছাড়া বর্ষার সময় এবং বর্ষার পরের জরিপ করা হয়নি, যা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের ব্যর্থতা হিসেবে ধরা হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবুল জামিল ফয়সাল বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ দেশের বিভিন্ন পৌরসভায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালিত হয়নি। এর ফলে মশা নির্মূলের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।
মুগদা হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর ভিড়
রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেপ্টেম্বরে ৩ হাজারের বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ৮৩৯ জনই শিশু। হাসপাতালের সহকারী পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান জানিয়েছেন, ডেঙ্গুর লক্ষণগুলোর মধ্যে শক সিনড্রোম বেশি দেখা যাচ্ছে। তবে গত বছরের তুলনায় রোগীর সংখ্যা কম।
মুগদা হাসপাতালে নারায়ণগঞ্জসহ ঢাকার আশপাশের জেলা থেকে রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসছেন। হাসপাতালের ডেঙ্গু রোগীদের জন্য ১২ তলা পর্যন্ত প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে সরকার মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতালকেও ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত রেখেছে।
সরকারের ডেঙ্গু মোকাবিলায় উদ্যোগ
ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় গতকাল সোমবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে দুটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে। প্রতিটি কমিটিতে দেশের তিনজন বিশেষজ্ঞকে সদস্য করা হয়েছে। এ কমিটির মাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ আরও জোরদার করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। সরকারের উচিত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া এবং স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয় তৈরি করা।
পরিস্থিতি আরও নাজুক হওয়ার আশঙ্কা
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, অক্টোবর মাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। কারণ, বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি মশার বিস্তারও অব্যাহত থাকবে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম বিভাগেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে, যা মাঠপর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক শেখ দাউদ আদনান বলেন, ‘ডেঙ্গুতে মৃত্যুর বিষয়টি উদ্বেগজনক। এর নিয়ন্ত্রণে আমরা কাজ করছি।’ তবে মাঠপর্যায়ে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে করণীয়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু মোকাবিলায় সরকারকে সুনির্দিষ্ট ও সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঘনিষ্ঠ সমন্বয় করে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এডিস মশার লার্ভা ধ্বংসে নিয়মিত জরিপ এবং অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
এছাড়া, জনসাধারণকে সচেতন করতে ব্যাপক প্রচার চালানোর পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় উন্নতি ঘটানো প্রয়োজন। ডেঙ্গুর লক্ষণ ও প্রতিরোধ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে সরকারকে আরও উদ্যোগী হতে হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।