গত দুই বছরে উদ্বোধিত পদ্মা রেল, কক্সবাজার রেলপথ, ঢাকার মেট্রো, চট্টগ্রাম টানেল। প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগের ফেরত মিলছে না প্রত্যাশামতো
দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে চলতি দুই বছরে একাধিক মেগা প্রকল্প চালু হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কক্সবাজার রেলপথ, ঢাকার মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, ও পদ্মা সেতু সংযোগ রেলপথ। তবে এসব প্রকল্প উদ্বোধনের পর দেখা গেছে, পরিচালনা ব্যয় ও ঋণ পরিশোধের খরচ আয় দিয়ে তোলা যাচ্ছে না। আর এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে বিপুল অর্থ।
মোট ৫৬ হাজার কোটি টাকার বিদেশি ঋণে নির্মিত এসব মেগা প্রকল্পের ঋণ পরিশোধে বার্ষিক ৩ হাজার কোটি টাকার কিস্তি দিতে হচ্ছে সরকারকে। আয় থেকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ অর্থসংস্থান করতে না পারায় ঋণ পরিশোধে সরকারের পক্ষ থেকে রাজস্ব ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
কক্সবাজার রেলপথে আয় দিয়ে ব্যয় তুলতে পারছে না সরকার
কক্সবাজারের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন রেলপথ চালু হয়েছে ২০২২ সালে। এ প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। মোট ঋণের পরিমাণ ৯ হাজার ৯৩ কোটি টাকা, যা পরিশোধ করতে সময় ধরা হয়েছে ২০ বছর। তবে বার্ষিক গড়ে ৪৫৫ কোটি টাকার কিস্তি ছাড়াও ২ শতাংশ সুদ দিতে হচ্ছে।
কক্সবাজার রেলপথ চালুর পর থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে তিনটি ট্রেন পরিচালনা করে ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৭১ কোটি টাকা আয় করেছে। তবে এ আয় দিয়ে প্রকল্পের পরিচালনা ব্যয় তুলতে পারছে না রেলওয়ে। ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে ভর্তুকির বোঝা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কক্সবাজার রেলপথটি লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা কম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ ভবিষ্যতে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর চালুর পর কিছু পণ্যবাহী ট্রেন চালানোর সুযোগ থাকলেও এটি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে না।
মেট্রোরেল: ঢাকার যানজট নিরসনে ভূমিকা, তবে আয় দিয়ে ঋণ পরিশোধ সম্ভব নয়
ঢাকার যানজট নিরসনে মেট্রোরেল লাইন-৬ প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ প্রকল্পে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ঋণ দিয়েছে ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা, যা পরিশোধে ৩০ বছর সময় পাওয়া যাবে। তবে এ ঋণ পরিশোধ করতে বার্ষিক গড়ে ৬৫৭ কোটি টাকার কিস্তি দিতে হচ্ছে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মেট্রোরেল ১৯৫ কোটি টাকা আয় করলেও, প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ তুলতে হলে প্রতিদিন অন্তত ৩ কোটি টাকা আয় করতে হবে বলে ধারণা দেয়া হচ্ছে।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রউফ মনে করেন, প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হলে আয় বাড়বে, তখন ঋণ পরিশোধও সম্ভব হবে। তবে আপাতত ঋণ পরিশোধে প্রকল্পের বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে খরচ মেটানো হচ্ছে।
কর্ণফুলী টানেল: পরিচালনায় আয়-ব্যয় সামঞ্জস্যে ঘাটতি
চীনের ঋণে বাস্তবায়িত কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পে মোট খরচ হয়েছে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঋণের পরিমাণ ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা, যা পরিশোধে সময় দেয়া হয়েছে ১৫ বছর। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে নির্মিত টানেলটি উদ্বোধনের পর প্রথম বছরে (অক্টোবর ২০২৩ থেকে অক্টোবর ২০২৪) প্রায় ৩৭ কোটি টাকা আয় হয়েছে। তবে টানেলটির রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বছরে প্রায় ১৩৬ কোটি টাকা, যা আয় দিয়ে মেটানো সম্ভব হচ্ছে না।
সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা বলছেন, আয়-ব্যয়ের ঘাটতি কমিয়ে ভবিষ্যতে লাভজনক অবস্থায় নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। তবে চীনের ঋণ কিস্তি পরিশোধের জন্য রাজস্ব ভর্তুকি দেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান মনে করেন, টানেল প্রকল্পটির আয় বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও, এটি দেশের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ: দীর্ঘমেয়াদি লাভের চেয়ে ঋণ পরিশোধের বোঝা বেশি
পদ্মা সেতু সংযোগ রেলপথ প্রকল্পে মোট ব্যয় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে ঋণ ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। ছয় বছরের গ্রেস পিরিয়ড শেষে এ বছরের এপ্রিল থেকে ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। বার্ষিক কিস্তি গড়ে ১ হাজার ৫০২ কোটি টাকা, যা ১৪ বছরে পরিশোধ করতে হবে।
২০২৩ সালের ১ নভেম্বর থেকে আংশিকভাবে চালু হওয়া পদ্মা রেলপথ দিয়ে বর্তমানে তিনটি আন্তঃনগর ও দুটি মেইল ট্রেন চলছে। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত আয় হয়েছে ৩৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা। আয় দিয়ে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান না হওয়ায় ঋণ পরিশোধে ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার।
অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক মনে করেন, পদ্মা রেল প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য উচ্চাভিলাষী প্রাক্কলন করা হয়েছে। রেলপথটি পণ্য পরিবহনকে প্রাধান্য দিয়ে তৈরি না করার কারণে আয় বাড়ানোর সম্ভাবনা কম। এ ঋণ দেশের অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।
বিদেশী ঋণে পরিচালিত মেগা প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বেশ কয়েকটি বিদেশী ঋণনির্ভর মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে এসব প্রকল্পের লাভজনকতা ও ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, কর্ণফুলী টানেল ও পদ্মা সেতু সংযোগ রেলপথ বর্তমান সরকারের বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি আরো বলেন, ‘টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচল বাড়ানোর চেষ্টা চলছে, পদ্মা সেতু সংযোগ রেলপথে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। তবে এসব প্রকল্প দেশের অর্থনীতিতে চাপ বাড়াচ্ছে। দায়িত্বজ্ঞানহীন এসব প্রকল্পের কারণে পুরো দেশ ভুগছে।’
বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা এবং চীনের ঋণে দেশের অবকাঠামো খাতে এতো বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও, বর্তমানে তাদের ঋণ পরিশোধ করতে রাজস্ব ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য এ ধরনের ঋণনির্ভর প্রকল্পের গুরুত্ব ও লাভজনকতা নিয়ে সরকারকে পুনর্বিবেচনা করতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।