বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
মাত্র তিন মাসে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাংক থেকে লুটপাট হওয়া অর্থই এখন খেলাপি ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা এবং সাধারণ মানুষ দারুণ উদ্বিগ্ন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই ঋণ সংকট সামাল দিতে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
খেলাপি ঋণে অতীত থেকে বর্তমান
বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য গতি শুরু হয় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে।
ওই সময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা।
এরপর এক দশকের বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকে।
২০২৩ সালের জুনে এটি ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০০৯ সালের পর সরকারি ছত্রচ্ছায়ায় বিতরণ করা ঋণের একটি বড় অংশ লুটপাট ও বিদেশে পাচার হয়েছে।
বিশেষত, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক প্রভাবশালী গোষ্ঠী ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দেওয়ায় এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংক খাতের প্রকৃত চিত্র স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।
গত পাঁচ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পতনের পর এটি প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে এসেছে।
সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের সংকট
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন থেকে সেপ্টেম্বর—এই তিন মাসে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি।
এই সময়ে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪৯ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা।
অন্যদিকে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা।
বিশেষত ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়ার পর এসব ব্যাংকের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।
এছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ এবং এস আলম গ্রুপের মতো বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে।
এসব বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী থেকে ঋণের বিশাল পরিমাণ ফেরত না পাওয়ার কারণেই খেলাপি ঋণের মাত্রা দ্রুত বেড়ে গেছে।
প্রকৃত চিত্র আরও গুরুতর
ব্যাংক খাত বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রকাশিত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রকৃত চিত্রের তুলনায় অনেকটাই কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অবলোপন করা ঋণ এবং আদালতের আদেশে স্থগিত থাকা ঋণ খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হয়নি।
অবলোপন করা ঋণ হচ্ছে এমন ঋণ, যা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আদায় সম্ভব নয় বলে বিবেচনা করে হিসাব থেকে বাদ দিয়ে দেয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অবলোপন করা ঋণের পরিমাণও বিশাল।
যদি এই পরিমাণ যোগ করা হয়, তাহলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে।
সরকার পরিবর্তনের পর নতুন নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর আওতায় ব্যাংকগুলো এখন প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, “আগামীতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পুরো চিত্র আরও স্পষ্ট হবে।”
সংস্কারের উদ্যোগ ও পথের বাঁধা
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ব্যাংক খাত সংস্কারে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।
তবে, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে যে উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়েছে, সেগুলো কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধুমাত্র নতুন নীতিমালা প্রণয়ন যথেষ্ট নয়, বরং কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
একইসঙ্গে, ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার কোনো বিকল্প নেই।”
অন্যদিকে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট কাটানোর জন্যও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষত, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে মজবুত করার জন্য আরও কার্যকর ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন।
সামনের দিনগুলোতে কী অপেক্ষা করছে?
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সংকট দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খেলাপি ঋণের বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে।
ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ কাঠামো ছাড়া খেলাপি ঋণ সংকট নিরসন সম্ভব নয়।
অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে, তবে সেগুলোর সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের ব্যাংকিং খাতের এই সংকট কাটিয়ে উঠতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং কার্যকর সংস্কার নীতিমালা অপরিহার্য।
এখন দেখার বিষয় হলো, নতুন সরকার কীভাবে এই সংকট মোকাবিলা করে এবং দেশের অর্থনীতিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনে।