চাকরিচ্যুতি ও দাবিদাওয়ার প্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ খাতে অচলাবস্থার আশঙ্কা
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে সাম্প্রতিক সময়ে নজিরবিহীন অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় চলমান সমস্যাগুলো নিয়ে মাঠে নেমেছেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (পবিস) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বিদ্যুৎ খাতের শ্রমিক-কর্মচারীরা ২৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছাঁটাই ও অন্যান্য দাবির প্রেক্ষিতে আন্দোলন শুরু করেছেন। এর মধ্যে কয়েকজন আন্দোলনকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গ্রেফতারের পর তাদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এ ঘটনাপ্রবাহে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় বড় ধরনের সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ছাঁটাই, মামলা ও গ্রেফতার: সংকটের উৎপত্তি
গত কিছুদিনে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অন্তত ২৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া, কয়েকজনের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে মামলা করা হয়েছে, এবং গ্রেফতার করা হয়। লক্ষ্মীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার আলী হাসান মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সহকারী জেনারেল ম্যানেজার এসকে শাকিল আহমেদকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এর আগে, ১৮ অক্টোবর আরও ছয় কর্মকর্তাকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। এই পরিস্থিতিতে অনেক কর্মকর্তা তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে কর্মস্থলে উপস্থিত হতে ভয় পাচ্ছেন।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আন্দোলনের প্রেক্ষাপট
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁদের চার দফা দাবি আদায়ে আন্দোলনে নেমেছেন। দাবিগুলো হলো:
• চাকরিচ্যুত ২৪ জন কর্মকর্তার পুনর্বহাল এবং দুইজন স্ট্যান্ড রিলিজ কর্মকর্তার পুনরায় পদায়ন।
• পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ও বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি) একীভূত করে একটি একক প্রতিষ্ঠান গঠন।
• স্থায়ী পদের বিপরীতে থাকা চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তাদের নিয়মিতকরণ।
• বিআরইবির দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনা।
সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী কর্মকর্তারা জানান, গত কয়েকদিন ধরে চলমান অস্থিরতার ফলে গ্রাহক সেবায় বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মতে, এই সমস্যার সমাধান না হলে দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় গুরুতর ঝুঁকি দেখা দিতে পারে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের আন্দোলন
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির চলমান আন্দোলনের মধ্যেই নতুন করে আন্দোলনে নেমেছে নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির (এনডব্লিউপিজিসিএল) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের তিনটি প্রধান দাবি হলো:
• বকেয়া পাওনা পরিশোধ।
• ওভারটাইম সুবিধা পুনর্বহাল।
• শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি চালু করা।
আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এনডব্লিউপিজিসিএল-এর অন্তত ৫০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মবিরতি পালন করছেন, তবে টেকনিক্যাল কর্মীরা বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রেখেছেন। আন্দোলনকারীদের দাবি আদায় না হলে তারা আরও কঠোর পদক্ষেপ নেবে বলে জানিয়েছেন। এর ফলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় অচলাবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।
বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রভাব ও বিপর্যয়ের শঙ্কা
পল্লী বিদ্যুতের এই আন্দোলনের ফলে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তীব্র লোডশেডিং ও ব্ল্যাকআউটের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, এই পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না আনলে দেশের বিদ্যুৎ গ্রিডে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। একদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালনের ক্ষেত্রে সরাসরি বাধা সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে, গ্রাহকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। এর ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহে আরও বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
বিদ্যুৎ খাতের সমস্যা সমাধানে প্রচেষ্টা
বিদ্যুৎ খাতে এই অস্থিরতার মধ্যে ক্যাব (কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেছে, যা পরিস্থিতি নিরসনের জন্য কাজ করবে। ক্যাবের সভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, “বিআরইবি ও পল্লী বিদ্যুতের মধ্যে বিরোধের কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা হুমকির মুখে রয়েছে। জাতীয় কমিটি এই সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেবে এবং ভোক্তাদের ক্ষতি কমাতে কাজ করবে।”
সরকারের ভূমিকা ও দায়িত্ব
সরকারি কর্তৃপক্ষ এ সংকট নিরসনে যথাযথ উদ্যোগ নিয়েছে বলে উল্লেখ করা হলেও আন্দোলনকারীরা মনে করছেন, তাঁদের দাবি পূরণের ব্যাপারে যথেষ্ট অগ্রগতি হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে বলে আন্দোলনকারীরা অভিযোগ তুলেছেন। আন্দোলনকারীদের মতে, বিদ্যুৎ বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এই সংকট সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন না।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতামত
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বিদ্যুৎ খাতের চলমান অস্থিরতার মূল কারণ হিসেবে কাঠামোগত সমস্যা এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সরকারের দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্বকে চিহ্নিত করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে যেভাবে কাজ করেন, তাঁদের সেই পরিমাণ মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না। বুয়েটের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, “পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কার্যক্রম এখন অন্যান্য বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির সমতুল্য, তাই তাদেরকে আলাদা কোম্পানি হিসেবে গঠন করলে কোনো সমস্যা হবে না।”
অন্যদিকে, বিদ্যুৎ বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা দাবি করেছেন যে, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সঞ্চালন কার্যক্রম যাতে ব্যাহত না হয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তবে আন্দোলনকারীদের দাবির সমাধানে সময় লাগবে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
বিদ্যুৎ খাতের অস্থিতিশীলতার পেছনের কারণ
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের অস্থিতিশীলতা শুধু বর্তমান আন্দোলনের ফল নয়, বরং এটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার ফলাফল। দেশের বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা বিভিন্ন সংস্থার অধীনে পরিচালিত হওয়ায় এর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এছাড়া, বিদ্যুৎ খাতের কর্মী-কর্মচারীদের চাকরি নিরাপত্তা, বেতনবৃদ্ধি এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অনেক দিন ধরেই অসন্তোষ চলছে।
বিদ্যুৎ খাতে দ্রুতগতির পরিবর্তন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন। যদিও বিদ্যুতায়ন এখন প্রায় ১০০ শতাংশে পৌঁছেছে, বিদ্যুতের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও তদারকির অভাবে অনেক এলাকায় এখনও চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না।
সমঝোতার সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তাঁদের দাবি সমাধানের চেষ্টা করা হবে। এই আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা হলে সংকট কিছুটা কমে আসতে পারে। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সমস্যার সমাধান না হলে বিদ্যুৎ সরবরাহে দীর্ঘমেয়াদি সংকট দেখা দিতে পারে।
বিদ্যুৎ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, “আমরা চাইছি বিদ্যুৎ সরবরাহ কার্যক্রম যাতে ব্যাহত না হয়। আন্দোলনকারীদের দাবিগুলো বোর্ডে উত্থাপন করা হবে এবং সেখানেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
বিদ্যুৎ খাতের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎ খাতে যে অস্থিরতা চলছে, তা ভবিষ্যতে আরও বড় সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে, উৎপাদন এবং বিতরণ ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং বিদ্যুৎ খাতের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের জটিলতা সমস্যা আরও ঘনীভূত করছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদ্যুৎ সরবরাহে কোনও বিঘ্ন ঘটলে তার প্রভাব অর্থনীতি, শিল্প খাত এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপকভাবে পড়বে। এই পরিস্থিতিতে সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বিদ্যুৎ খাতের পুনর্গঠন প্রয়োজন।