,

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে উচ্চ আদালতে রিট: সংকট সমাধানে নতুন দিক নির্দেশনার অপেক্ষা

বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিটের শুনানি চলছে।

রায়ের মাধ্যমে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন হবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে ব্যাপক জল্পনা।

দেশে ১৩ বছর আগে বাতিল হওয়া এই ব্যবস্থার পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক আবারও সরগরম রাজনৈতিক অঙ্গনে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার: ইতিহাস ও বিতর্ক

১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রবর্তন হয় রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে।

তৎকালীন বিএনপি সরকারের সময়ে মাগুরা উপনির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগে বিরোধী দলগুলো নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি তোলে।

এরপর আন্দোলনের মুখে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যুক্ত হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

কিন্তু ২০০৬ সালে বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানানো নিয়ে সংকট তৈরি হয়।

এর ফলে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে ক্ষমতায় আসে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

এই পরিস্থিতি ‘ওয়ান ইলেভেন’ নামে পরিচিত, যা প্রায় দুই বছর স্থায়ী হয়।

২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার।

এই সংশোধনী নিয়ে বিরোধী দল বিএনপি ও অন্যদের মধ্যে শুরু হয় তীব্র বিতর্ক।

তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের পর ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি।

সেই নির্বাচন নিয়ে সহিংসতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার ঘটনা ঘটে দেশজুড়ে।

পঞ্চদশ সংশোধনীর পটভূমি

২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্ট ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে।

এই রায়ের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সরকার পঞ্চদশ সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে।

সংসদে বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে এই সংশোধনী পাস হয়।

পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী, নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষে সংসদ বহাল থাকবে এবং নির্বাচনকালীন সরকার রাষ্ট্রের রুটিন কাজ করবে।

তবে আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ে সংক্ষিপ্ত আদেশের সঙ্গে বড় ধরনের অসঙ্গতি ছিল।

যেখানে সংক্ষিপ্ত রায়ে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়ার কথা বলা হয়েছিল, সেখানে পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা বাদ যায়।

এই সিদ্ধান্ত নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক।

নতুন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরবে কি?

বর্তমানে আদালতে পঞ্চদশ সংশোধনীর বিরুদ্ধে রিটের শুনানি চলছে।

এই রিটে বলা হয়েছে, গণভোট ছাড়া সংবিধানের একাধিক অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনায় পঞ্চদশ সংশোধনী অসাংবিধানিক।

রিটকারীরা দাবি করেছেন, এই সংশোধনী বাতিল হলে দেশে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরবে।

তবে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু বাতিল করলেই হবে না; নতুন কোনো ব্যবস্থা চালুর দিকেও নির্দেশনা দিতে হবে।

সিনিয়র আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম বলেছেন, “তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা না ফিরলে নতুন কী পদ্ধতি চালু হবে, সেটি নিয়ে আদালতের নির্দেশনা প্রয়োজন।”

অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে সংবিধান সংস্কার নিয়ে একটি কমিটি কাজ করছে।

তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সুপারিশও করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

রাজনৈতিক অঙ্গনে পঞ্চদশ সংশোধনী

পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান বিপরীতমুখী।

আওয়ামী লীগ এই সংশোধনীকে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার পদক্ষেপ হিসেবে দেখেছে।

তবে বিএনপি বলেছে, এটি দেশে সংঘাত ও সাংবিধানিক সংকট তৈরি করেছে।

২০১১ সালে সংসদে সংশোধনী পাসের পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে কোনো ফর্মুলা থাকলে বলতে পারেন। অহেতুক জনগণকে কষ্ট দেবেন না।”

অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, “গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের সব পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভবিষ্যৎ: সংকটের সমাধান হবে কী?

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সংবিধান সংস্কারের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরবে কি না, তা নির্ধারণে উচ্চ আদালতের রায় গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে আদালতের রায় এবং অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা একটি নতুন দিক নির্দেশনা দিতে পারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরলে দেশে একটি অন্তর্বর্তী নির্বাচনকালীন সরকার পুনঃপ্রবর্তিত হতে পারে।

তবে আদালতের রায় যদি ভিন্নমুখী হয়, তবে নতুন কোনো কাঠামোতে নির্বাচন আয়োজনের বিষয়টি বিবেচনায় আসতে পারে।

এই প্রেক্ষাপটে সংবিধান সংশোধন নিয়ে আলোচনায় থাকছে বাংলাদেশ রাজনৈতিক অঙ্গনের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু।

আরও পড়তে পারেন