ঢাকার শেরে বাংলা নগরে বিশাল জায়গাজুড়ে স্থাপিত যে ভবনটি ‘গণভবন’ নামে পরিচিত, সেটি নিয়ে বিতর্কের সূচনা বেশ পুরনো। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গণভবন একটি উল্লেখযোগ্য ও কৌতূহল উদ্দীপক স্থাপনা হিসেবে পরিচিত। এই ভবনটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পর্ব, বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম।
গণভবনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
গণভবন মূলত রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও, পরবর্তীতে এটি রাজনৈতিক বিতর্ক এবং সংকটের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সময় এই ভবন নির্মাণ করা হয়। তবে শেখ মুজিব নিজে সেখানে বসবাস করতেন না। তিনি পরিবার নিয়ে থাকতেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে, যা পরবর্তীতে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর, গণভবন কার্যত পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। ১৯৮৫ সালে, সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ এর পুনঃসংস্কার করে এটি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন হিসেবে ব্যবহারের জন্য ‘করতোয়া’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এখানে বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা করা হতো। যেমন, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ঢাকা সফরের সময় এখানে অবস্থান করেছিলেন।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর, ‘করতোয়া’র নাম আবার ‘গণভবন’ করা হয়। এরপর থেকেই এই ভবনটি রাজনৈতিক বিতর্ক এবং সংলাপের কেন্দ্রবিন্দুতে রূপান্তরিত হয়।
শেখ হাসিনার বসবাস ও বিতর্কের শুরু
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন শেখ হাসিনা গণভবনে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু এই ভবনে তার স্থায়ীভাবে থাকার প্রচেষ্টা ও বরাদ্দ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক তীব্র হয়ে ওঠে। প্রধানমন্ত্রীত্ব ছাড়ার পরেও তিনি সেখানে থাকতে চেয়েছিলেন। তবে রাজনৈতিক চাপের মুখে শেখ হাসিনাকে ২০০১ সালে গণভবন ছাড়তে বাধ্য করা হয়।
গণভবনে শেখ হাসিনার থাকার সময়, ২০০১ সালের ২০ জুন, জাতীয় সংসদে ‘জাতির পিতার পরিবার সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন ২০০১’ পাস করা হয়। এই আইন অনুযায়ী, শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে আজীবন বিশেষ নিরাপত্তা এবং পৃথক আবাসন বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর আওতায়, ২ জুলাই শেখ হাসিনাকে গণভবন এবং শেখ রেহানাকে ধানমন্ডির ছয় নম্বর সড়কে একটি সরকারি বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এই বরাদ্দের পর থেকেই শুরু হয় বিতর্ক। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি শেখ হাসিনার গণভবনে থাকা নিয়ে আপত্তি তোলে এবং ব্যাপক প্রচারণা চালায়। বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া গণভবনে শেখ হাসিনার থাকার বিষয়ে কড়া আপত্তি জানান। তিনি বলেছিলেন, “নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে গণভবন ছাড়ুন।”
রাজনৈতিক চাপ ও প্রতিক্রিয়া
বিএনপি যখন রাজনৈতিক চাপ তৈরি করেছিল, তখন আওয়ামী লীগও পাল্টা কৌশল গ্রহণ করে। তারা খালেদা জিয়াকে তার সেনানিবাসের বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানায়। এই বিতর্কের মধ্যেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং ২০০১ সালের অগাস্ট মাসে শেখ হাসিনা গণভবন ছেড়ে যান।
গণভবন নিয়ে বিতর্কের আরেকটি প্রধান অধ্যায় হলো ২০০১ সালে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রিট আবেদন। এই রিট পিটিশনে ‘জাতির পিতার পরিবার সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন’কে বৈষম্যমূলক এবং অসাংবিধানিক বলে অভিহিত করা হয়। তবে এই রিট নিয়ে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি, কারণ এর মধ্যেই বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর এই আইনটি বাতিল করা হয়।
গণভবনের জাদুঘরে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত
সম্প্রতি, অধ্যাপক ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার গণভবনকে ‘জুলাই স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের কয়েকদিন আগেই লন্ডন থেকে এক ভিডিও বার্তায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান বলেছিলেন যে, গণভবনকে জাদুঘরে রূপান্তর করা হবে যেখানে জুলাই-অগাস্ট মাসে শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে যারা আহত-নিহত হয়েছেন তাদের স্মৃতি সংরক্ষণ করা হবে।
ভবিষ্যতের পথে গণভবন
গণভবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনো অনেক প্রশ্ন রয়েছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে, ভবনটি কি সম্পূর্ণরূপে জাদুঘরে রূপান্তরিত হবে, নাকি এটি নতুন কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
এদিকে, শেখ হাসিনা এখন আবারো গণভবনে বসবাস করছেন এবং তার শাসনামলের অনেক কাজ সেখান থেকে পরিচালিত হচ্ছে। গণভবন ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে, বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতির পরিবর্তনশীল গতিপথে এর ভূমিকা চিরদিন অমলিন থাকবে।