,

ঢাকার বায়ুদূষণ: শ্বাসতন্ত্রের রোগে ছেয়ে যাচ্ছে হাসপাতালগুলো

ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা শীতের শুরুতেই বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছেছে।

শুক্রবার রাতেও ঢাকা ছিল বিশ্বের দূষিত শহরগুলোর তালিকায় তৃতীয়।

পাকিস্তানের লাহোর এবং ভারতের দিল্লি এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণজনিত শ্বাসতন্ত্রের রোগের কারণে হাসপাতালগুলোতে রোগীর ভিড় বেড়েছে।

আগারগাঁওয়ের ২৫০ শয্যার যক্ষ্মা হাসপাতালে প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শীত পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শ্বাসকষ্ট এবং হাঁপানি রোগীদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।

মঙ্গলবার বহির্বিভাগে দেখা গিয়েছে ৩৮০ জন রোগী।

বৃহস্পতিবার সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫০ জনে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এক গবেষক বলছেন, বায়ুর মানের দ্রুত অবনতি শহরটির স্বাস্থ্য সঙ্কট আরও তীব্র করেছে।

বায়ুদূষণের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে শ্বাসতন্ত্রের রোগীদের ওপর।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুসারে, ঢাকার বাতাস এখন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।

বায়ুদূষণের কারণসমূহ

ঢাকার বায়ুদূষণের মূল কারণ হলো নির্মাণকাজ থেকে ছড়ানো ধুলা।

শহরের রাস্তায় প্রতিনিয়ত চলমান খোঁড়াখুঁড়ি বায়ুর মানের বড় ক্ষতি করছে।

বেশিরভাগ নির্মাণকাজে ধুলা নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হচ্ছে না কোনো ব্যবস্থা।

পৃথক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ইটভাটা ঢাকার বায়ুদূষণের দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ।

এসব ইটভাটা থেকে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ কালো ধোঁয়া নির্গত হয়।

পুরোনো যানবাহন এবং নিম্নমানের জ্বালানি ব্যবহারের ফলে নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইড এবং ব্ল্যাক কার্বন নিঃসরণ বেড়ে চলেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের তথ্য অনুযায়ী, শহরের বায়ুতে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ২০০৩ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

এ ছাড়াও, রান্নার চুলা এবং বর্জ্য পোড়ানো দূষণের আরো একটি বড় উৎস।

শীতের শুরুতে শহরের বিভিন্ন এলাকায় বর্জ্য পোড়ানোর পরিমাণ বেড়ে যায়।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা দেখিয়েছে, ঢাকার বায়ুর মানে আন্তর্দেশীয় দূষণেরও বড় ভূমিকা রয়েছে।

শীতকালে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আসা দূষিত বাতাস ঢাকার দূষণ বাড়িয়ে দেয়।

এছাড়াও, সালফার ডাই–অক্সাইড এবং অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা (PM 2.5) ঢাকার বায়ুতে মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এই উপাদানগুলোর সহনীয় মাত্রা ঢাকার বর্তমান অবস্থার অনেক নিচে।

স্বাস্থ্যগত প্রভাব

ঢাকার বায়ুদূষণের প্রভাব ইতোমধ্যে জনস্বাস্থ্যে বিপর্যয় তৈরি করেছে।

যক্ষ্মা এবং হাঁপানি রোগীদের সংখ্যায় বড় ধরনের বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে।

আগারগাঁওয়ের যক্ষ্মা হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা এক সপ্তাহে ৮০ থেকে বেড়ে ১০১-এ পৌঁছেছে।

জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, প্রতিদিন সেখানে গড়ে ৮০০ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন।

দুই সপ্তাহ আগেও এই সংখ্যা ছিল ৪০০ থেকে ৪৩০ জন।

চিকিৎসকরা বলছেন, বায়ুদূষণের সরাসরি প্রভাব পড়ছে ফুসফুসের ওপর।

শ্বাসকষ্ট এবং ব্রঙ্কাইটিসের মতো রোগগুলোতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

শীতের শুষ্ক বাতাসে দূষণের কণা মানুষের শ্বাসতন্ত্রে জমে যাচ্ছে।

একাধিক বিশেষজ্ঞের মতে, ঢাকার দূষণ শিশুদের এবং প্রবীণদের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে।

হাসপাতালগুলোতে হাঁপানি রোগী এবং শ্বাসকষ্টে ভোগা প্রবীণদের ভিড় বাড়ছে।

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা সায়েদা সুলতানা বলেছেন, শীত পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার শ্বাসকষ্ট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।

চিকিৎসকেরা বলছেন, ফুসফুসে জমে থাকা দূষণের কণা দূর করতে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুসারে, বায়ুদূষণের কারণে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ১.৫ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু হয়েছে।

সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের চাপ সামলানোর মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।

ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ না হলে শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

সরকারের উদ্যোগ ও বাস্তবতা

বায়ুদূষণ রোধে বাংলাদেশ সরকার একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দুইটি প্রকল্পে ৭২০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।

এর মধ্যে ২০১৯ সালে শেষ হওয়া নির্মল বায়ু প্রকল্প নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল।

বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বর্তমানে টেকসই পরিবেশ ও রূপান্তর প্রকল্প নামে নতুন একটি উদ্যোগ চলছে।

এই প্রকল্পে ২৫০০ কোটি টাকারও বেশি অর্থায়ন করা হয়েছে।

তবে, পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন অত্যন্ত ধীরগতির।

সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিবেশ রক্ষায় কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নতুন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন।

সরকারি স্থাপনায় পোড়া ইটের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে।

ফিটনেসবিহীন যানবাহন বন্ধে ছয় মাস সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

গাজীপুরে বিষাক্ত সিসা নির্গতকারী কয়েকটি ব্যাটারি কারখানায় অভিযান চালানো হয়েছে।

ইটভাটার লাইসেন্স নবায়ন বন্ধেরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

রাস্তায় ধুলাবালি কমাতে নিয়মিত পানি ছিটানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, গত অক্টোবরে ‘ন্যাশনাল এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান’ চালু করা হয়েছে।

এই পরিকল্পনার আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ ৩০ মাইক্রোগ্রাম কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিকল্পনা ভালো হলেও বাস্তবায়ন ছাড়া এর কোনো ফল হবে না।

বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় কার্যক্রম এখনো কার্যকর হয়নি।

কাজের কাজ না হলে ঢাকার মানুষ দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাবে না।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

পরিবেশবিদদের মতে, ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে বহু মন্ত্রণালয়ের একসঙ্গে কাজ করা জরুরি।

ঢাকার রাস্তায় নির্মাণকাজ এবং ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের গবেষকরা বলছেন, নির্মাণকাজ ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উৎস।

যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং পুরোনো ইটভাটা বন্ধে আরও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, বায়ুদূষণের প্রধান উপাদানগুলোর পরিমাণ প্রতি বছর বাড়ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহনীয় মানের চেয়ে ঢাকার বায়ু এখন অনেক দূষিত।

বিশ্বব্যাংক বলছে, বায়ুদূষণের কারণে ২০১৯ সালে বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১৭.৬ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বায়ুদূষণ রোধে জনগণের সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।

বর্জ্য পুড়িয়ে ধোঁয়া তৈরি বন্ধে সরকারি নির্দেশনা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা প্রয়োজন।

শুধু পরিকল্পনা নয়, বাস্তবায়নে নজরদারি এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

উপসংহার

ঢাকার বায়ুদূষণ একটি বহুস্তরের সঙ্কট, যা জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনীতির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

পরিকল্পনা এবং প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও কার্যকর বাস্তবায়নের অভাব সমস্যাকে আরও গভীর করছে।

সরকারের নেওয়া সাম্প্রতিক উদ্যোগগুলো প্রশংসনীয় হলেও দীর্ঘমেয়াদে এর ফলাফল দেখতে হবে।

পরিবেশের এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কৌশলগত সমন্বয় এবং জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই ব্যবস্থা না নিলে ঢাকার বাতাস আগামী প্রজন্মের জন্য আরও প্রাণঘাতী হয়ে উঠবে।

ঢাকাবাসী এখন অপেক্ষা করছে, প্রতিশ্রুতিগুলো কখন বাস্তবে রূপ নেবে।

আরও পড়তে পারেন