মোবাইল ফোন

ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি: ধীরগতির মোবাইল ইন্টারনেট এবং উচ্চ মূল্যের কারণ বিশ্লেষণ

বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেটের গতি প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অন্যতম ধীর। এমনকি মিয়ানমারের চেয়েও পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ, যেখানে মোবাইল ডেটার দাম ভারতের মতো দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণে এতটা সময় লাগার পেছনে কী কী কারণ দায়ী?

দুর্নীতি এবং অদক্ষতার প্রতিবন্ধকতা

বাংলাদেশের ডিজিটাল খাতে অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করছে দুর্নীতি এবং অদক্ষতা। “ডিজিটাল বাংলাদেশ” উদ্যোগে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ হলেও, এর যথাযথ ব্যবহার না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আসছে না। গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোর জন্য বরাদ্দকৃত তহবিলের অপব্যবহার এবং সঠিকভাবে সংস্থাপন না করার কারণে ডিজিটাল বাংলাদেশ স্বপ্ন এখনও বাস্তবায়িত হতে পারেনি।

ইন্টারনেট ভ্যালু চেইনে অসামঞ্জস্যতা

বাংলাদেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটররা ইন্টারনেট ভ্যালু চেইনের মূল স্তরগুলো যেমন সাবমেরিন কেবল, আন্তর্জাতিক টেরেস্ট্রিয়াল কেবল, ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (IIG), ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (NTTN) এবং টাওয়ার সংক্রান্ত কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণে নেই। এই স্তরগুলো অন্যান্য সংস্থার নিয়ন্ত্রণে থাকায় মোবাইল অপারেটরদের কার্যক্রমে ব্যয় বেড়ে যায় এবং প্রতিযোগিতায় ব্যাঘাত ঘটে। এর ফলে ডেটার দাম বেড়ে যায় এবং উদ্ভাবন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়।

টাওয়ার ফাইবারাইজেশনের অভাব

মোবাইল ডেটার গতি এবং পরিষেবার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো টাওয়ারগুলোর ফাইবার নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্তির ঘাটতি। বাংলাদেশে মাত্র ২০ শতাংশ মোবাইল টাওয়ার ফাইবারের সঙ্গে সংযুক্ত, যা ৪জি এবং ৫জি নেটওয়ার্কের জন্য প্রয়োজনীয় উচ্চগতির ইন্টারনেট সরবরাহের ক্ষেত্রে বড় বাধা সৃষ্টি করে। ফাইবার নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি ছাড়া বাংলাদেশে নির্ভরযোগ্য মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদান সম্ভব নয়।

টাওয়ার স্থাপনের চ্যালেঞ্জ এবং এর প্রভাব

নতুন টাওয়ার স্থাপনে দেরি এবং অন্যান্য অদক্ষতা বাংলাদেশের মোবাইল পরিষেবার উন্নয়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাইট অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার বিলম্ব, আইনি জটিলতা এবং প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো স্থাপন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে মোবাইল নেটওয়ার্কের টাওয়ার কভারেজ যথাযথভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে না, যার ফলে মোবাইল ইন্টারনেটের গতি ও পরিষেবার মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

DWDM প্রযুক্তি ব্যবহারে বাধা

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (BTRC) মোবাইল অপারেটরদের DWDM (Dense Wavelength Division Multiplexing) প্রযুক্তি ব্যবহারের অনুমতি দেয়নি। DWDM প্রযুক্তি একই ফাইবারের মাধ্যমে একাধিক ডেটা স্ট্রিম পরিচালনা করার সুযোগ দেয়, যা নেটওয়ার্কের কার্যকারিতা ও সক্ষমতা বাড়ায়। এই প্রযুক্তির অভাবে বাংলাদেশের ডিজিটাল অবকাঠামো বিকাশে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।

স্মার্টফোন গ্রহণ এবং নিয়ন্ত্রক চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের ডিজিটাল উন্নয়নে আরেকটি বড় বাধা হলো ধীর গতির স্মার্টফোন গ্রহণ। বিশেষ করে ৫জি প্রযুক্তির সঠিক বাস্তবায়নের জন্য আরও বেশি স্মার্টফোন ব্যবহারকারী প্রয়োজন। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় BTRC-এর উচিত নেটওয়ার্ক-লকড হ্যান্ডসেটের জন্য বিশেষ নিয়মাবলী প্রণয়ন করা এবং সহজলভ্য ফাইন্যান্সিং সুবিধা প্রদান করা।

সক্রিয় অবকাঠামো ভাগাভাগির সম্ভাবনা

অবকাঠামো ঘাটতি পূরণের অন্যতম সমাধান হতে পারে সক্রিয় অবকাঠামো ভাগাভাগির ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে টেলিকম অপারেটররা একে অপরের সঙ্গে রেডিও অ্যাকসেস নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম এবং ফাইবার ব্যাকবোনের মতো নেটওয়ার্ক উপাদানগুলো ভাগাভাগি করতে পারবে, যার ফলে নেটওয়ার্ক নির্মাণের ব্যয় কমবে এবং দ্রুত পরিষেবা দেওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে।

BTRC-এর স্বাধীনতার সংকট এবং রাজনৈতিক প্রভাব

২০১০ সালের সংশোধনের পর থেকে BTRC তার নিয়ন্ত্রক স্বাধীনতার একটি বড় অংশ হারিয়েছে। এই পরিবর্তনের ফলে রাজনৈতিক প্রভাব ও বহিরাগত চাপ সৃষ্টি হয়েছে, যা কিছু নির্দিষ্ট পক্ষকে সুবিধা দিয়েছে এবং শিল্পের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করেছে। BTRC-এর স্বায়ত্তশাসন পুনরুদ্ধার এবং রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্তি পেলে টেলিকম খাতে ন্যায্য নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

দেশের ভবিষ্যৎ ডিজিটাল সাফল্যের পথ

উচ্চমূল্যের ডেটা এবং ধীরগতির ইন্টারনেট শুধু ভোক্তাদের জন্য অসুবিধাজনক নয়, বরং শিক্ষার সুযোগ সীমিত করে, ব্যবসার অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করে এবং বৈশ্বিক ডিজিটাল অর্থনীতিতে প্রবেশের সুযোগও আটকে দেয়। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারলে বাংলাদেশ তার মোবাইল ডেটার গতি বাড়াতে এবং খরচ কমাতে সক্ষম হবে। এর মাধ্যমে দেশের জনগণকে একটি সত্যিকারের ডিজিটাল ভবিষ্যৎ উপহার দেওয়া সম্ভব হবে।

এটি অর্জনের জন্য সরকার এবং টেলিকম নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে একযোগে কাজ করতে হবে, অদক্ষতা কমাতে হবে এবং সবার জন্য দ্রুত ও সাশ্রয়ী ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করতে হবে।

আরও পড়তে পারেন