টানা তৃতীয় বছরেও ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়ন অব্যাহত রয়েছে।
চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত টাকার মূল্যমান ৯ শতাংশের বেশি কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত বিনিময় হারে এই অবমূল্যায়ন হিসাব করা হয়েছে।
তবে খোলা বাজার বা কার্ব মার্কেটে টাকার দর আরো বেশি কমেছে।
২০২৪ সালে টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে সাড়ে ১৪ শতাংশ।
এশিয়ার উল্লেখযোগ্য মুদ্রাগুলোর মধ্যে ২০২৪ সালে টাকার অবস্থান সবচেয়ে দুর্বল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত বিনিময় হার
২০২৪ সালের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত সর্বোচ্চ বিনিময় হার ছিল ১১০ টাকা।
গতকাল (১৭ ডিসেম্বর) এই দর বাড়িয়ে ১২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ হিসাবে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেছে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ।
তবে ব্যাংকগুলো এখন রেমিট্যান্সের ডলার কিনছে ১২৬ টাকায়।
ডলারের অঘোষিত বিনিময় হার অনুযায়ী, চলতি বছর টাকার অবমূল্যায়ন ১৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
গত তিন বছরে এশিয়ার মধ্যে টাকার অবমূল্যায়নই সবচেয়ে বেশি।
২০২২ সালের জানুয়ারির তুলনায় এই সময়ে টাকার অবমূল্যায়নের হার দাঁড়িয়েছে ৪৭ শতাংশ।
এশিয়ার অন্যান্য মুদ্রার তুলনামূলক অবস্থা
এশিয়ার ২০টিরও বেশি অর্থনীতির মধ্যে কেবল টাকা ও দক্ষিণ কোরিয়ার ওনের অবমূল্যায়ন বেশি হয়েছে।
২০২৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার মুদ্রা ওনের মূল্যমান কমেছে ১০ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
জাপানের ইয়েন ৬ দশমিক ৭১ শতাংশ, ফিলিপাইনের পেসো ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ ও ভিয়েতনামের ডং ৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে।
চাইনিজ ইউয়ান এবং ইন্দোনেশিয়ান রুপিয়ার অবমূল্যায়নের হার যথাক্রমে ২ দশমিক ৪২ ও ২ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
ভারতীয় রুপির অবমূল্যায়ন হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সিঙ্গাপুরি ডলারের মূল্যমান কমেছে ১ দশমিক ২৯ শতাংশ।
তবে কয়েকটি দেশের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে শক্তিশালীও হয়েছে।
শ্রীলংকার রুপির মূল্যমান বেড়েছে ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ।
মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত এবং পাকিস্তানি রুপির মূল্যমান বেড়েছে যথাক্রমে ৩ দশমিক ৮২ এবং ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
টাকার অবমূল্যায়নের কারণ ও প্রেক্ষাপট
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক দশক আগে ডলারের দর স্থির রাখার নীতি টাকার বর্তমান দুরবস্থার জন্য দায়ী।
২০১২ সাল থেকে ডলারের বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তবে ২০২২ সাল-পরবর্তী সময়ে টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকানো যায়নি।
রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল।
এ নীতি কার্যকর না হওয়ায় টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন ঘটেছে।
রিজার্ভে চাপ সৃষ্টি হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে।
চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি চালু করে।
এই নীতির আওতায় ডলারের দর ধাপে ধাপে বাড়ানোর সুযোগ রাখা হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ডলারের দর বাড়িয়ে ১২০ টাকায় উন্নীত করা হয়।
তবে ডলারের মূল্য এখনো সর্বোচ্চ পর্যায়েই রয়ে গেছে।
অর্থনীতিবিদদের মতামত
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি অতীতের ভুল নীতির ফল।
ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে না দিয়ে ধরে রাখা হয়েছিল।
এর ফলে রিজার্ভ কমেছে, টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়ন হয়েছে, এবং মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ডলারের বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
তিনি আরও জানান, ডলারের চাহিদা বাড়লেও রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় থেকে ডলারের জোগানও বেড়েছে।
বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আইএমএফসহ দাতা সংস্থাগুলোর ঋণ সহায়তা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে।
শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের ঘুরে দাঁড়ানো, ব্যতিক্রম বাংলাদেশ
অর্থনৈতিক সংকটে থাকা শ্রীলংকা ও পাকিস্তান ইতোমধ্যে স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে।
শ্রীলংকায় রুপির মান বেড়েছে ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি কমতে কমতে দেশটি ঋণাত্মক ধারায় চলে এসেছে।
পাকিস্তানে রুপির মান বেড়েছে এবং মূল্যস্ফীতিও ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশে এখনো মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশের ওপরে রয়েছে।
ডলারের বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় টাকার দুর্বলতা আরো প্রকট হচ্ছে।
টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তবে রিজার্ভের চাপ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিকল্প নীতির কথা ভাবছে।