জীবন রক্ষাকারী ৫০টিরও বেশি ওষুধের দাম সম্প্রতি ১০ থেকে ১১০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
গত তিন মাসে কিছু ওষুধের মূল্য দ্বিগুণ হওয়ায় সাধারণ মানুষ ব্যাপক অর্থনৈতিক চাপে পড়েছে।
অ্যান্টিবায়োটিক, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের মতো রোগের ওষুধগুলো এখন অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।
সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকা ১১৭টি ওষুধের বাইরে থাকা বেশিরভাগ ওষুধের দাম উৎপাদক প্রতিষ্ঠান নিজেরাই নির্ধারণ করছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নিয়ম মেনে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো অনুমোদন ছাড়াই বাজারে দাম বৃদ্ধি কার্যকর করেছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর জানিয়েছে, বেশিরভাগ কোম্পানি অনুমোদনের আগে বাজারে দাম বাড়িয়ে আবেদন করে নিয়ম লঙ্ঘন করেছে।
রাজধানীর ফার্মেসি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৩০-৫০ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ১১টি ওষুধের।
শিশুদের সর্দি-কাশির সিরাপ, গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ এবং উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ওষুধের দাম সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
দাম বৃদ্ধির তালিকায় স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, এসিআই, বীকন ফার্মাসিউটিক্যালসসহ শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি কোম্পানির নাম রয়েছে।
রাজধানীর আজিমপুরের বাসিন্দা মো. শাহিনূর জানান, হৃদরোগের ওষুধের খরচ এখন তাঁর পরিবারে খাদ্যব্যয়ের চেয়েও বেশি।
একইভাবে, দিনমজুর নজরুল ইসলাম ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতি মাসে ৭ হাজার টাকার ওষুধ কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।
এমন পরিস্থিতিতে অনেকে খাদ্যপণ্যে কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছেন, যা দীর্ঘমেয়াদে পুষ্টি ঘাটতির ঝুঁকি তৈরি করছে।
ফার্মেসি দোকানিরা জানান, এমজার্ড, ডাইমাইক্রন, ওভোক্যাল, এবং গ্যাস্ট্রিকের ফ্যামোট্যাকের মতো সাধারণ ওষুধগুলোর দামও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
শীতকালীন অ্যালার্জির ওষুধ রুপিন এবং মাইগ্রেনের জন্য ব্যবহৃত ফ্লুভারের দামও তিনগুণের কাছাকাছি বৃদ্ধি পেয়েছে।
মূত্রথলির ওষুধ ইউট্রোবিন এবং ডায়াবেটিসের জন্য জনপ্রিয় এমপামেট ট্যাবলেটের দাম যথাক্রমে ১৫০ এবং ২০০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।
নারীর প্রজননজনিত সমস্যার জন্য ব্যবহৃত ডাইনোজেস্ট এবং অস্ত্রোপচারের ব্যথানাশক টোরাক্সের দাম এক লাফে প্রায় ১১০ শতাংশ বেড়েছে।
ভোক্তাদের মধ্যে ক্ষোভ এবং হতাশা ক্রমাগত বাড়ছে, কারণ ওষুধের দাম বৃদ্ধির এই ধারা তাদের জীবনের মৌলিক চাহিদাকে সংকটে ফেলেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন অবস্থা চলতে থাকলে দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি চিকিৎসার বাইরে চলে যাবে।
দাম বৃদ্ধির কারণ ও উৎপাদকদের যুক্তি
ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দাবি করছে, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং ডলার সংকটের কারণে মূল্য সমন্বয় করতে হয়েছে।
তারা বলছে, জ্বালানি তেলের দাম এবং আমদানিকৃত কাঁচামালের ব্যয় বৃদ্ধির কারণে কিছু ওষুধ উৎপাদন লাভজনক ছিল না।
বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এম শফিউজ্জামান জানান, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে উৎপাদন খরচ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
তবে তিন মাসে কোনো নতুন ওষুধের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়নি বলে দাবি করেছেন তিনি।
উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো অভিযোগ করে বলছে, কাঁচামাল আমদানি করতে গিয়ে চীন ও ভারত থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।
তবে ঔষধ প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, কোম্পানিগুলো অনেক সময় চীনা কাঁচামালকে ইউরোপীয় হিসেবে দেখিয়ে বাড়তি দাম দাবি করে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে নতুন দাম কার্যকর করেছে।
ঔষধ প্রশাসনের সাবেক উপপরিচালক নুরুল আলম জানান, বেশিরভাগ দাম বৃদ্ধিই অযৌক্তিক এবং বাজারের অব্যবস্থাপনার ফল।
তিনি বলেন, কাঁচামাল এবং উৎপাদন খরচের অজুহাতে কোম্পানিগুলো নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছে।
নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের অক্ষমতা এবং বাজারে নজরদারির অভাব এই পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলেছে।
উৎপাদকরা বলছে, ওষুধের দাম না বাড়ালে অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদন বন্ধ করতে হবে, যা বাজার সংকট তৈরি করতে পারে।
অন্যদিকে, বিশ্লেষকরা মনে করেন, মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
ওষুধের দাম বৃদ্ধি নিয়ে সরকারের আরও কার্যকর ভূমিকা নেওয়া জরুরি বলে মত দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
প্রভাব ওষুধ প্রশাসনের ব্যর্থতায় এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেছেন, ঔষধ প্রশাসনের সক্ষমতায় ঘাটতি রয়েছে।
তিনি জানান, ওষুধের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা বাজারে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে।
তারা নিয়ম লঙ্ঘনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, ফলে ভোক্তারা ক্রমাগত ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিশালী অবস্থানের কারণে সরকার ও প্রশাসন তাদের চাপে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।
নিয়ন্ত্রণ সংস্থার দুর্বলতা এবং বাজার তদারকির অভাব কোম্পানিগুলোর জন্য অযৌক্তিক দাম বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করেছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে-নজির আহমেদ বলেছেন, এই পরিস্থিতি স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য তৈরি করবে।
তিনি সতর্ক করেছেন, উচ্চ ও নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবায় পার্থক্য আরও গভীর হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
ওষুধের উচ্চমূল্য কেবল রোগ প্রতিরোধ নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে পুষ্টি ও জীবনের মানেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং ঔষধ প্রশাসনের যৌথ পদক্ষেপ নেওয়া এখন অত্যন্ত জরুরি।
নিয়ন্ত্রণহীন বাজার ও সম্ভাব্য সমাধান
বাজারে ওষুধের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণে প্রশাসনের প্রতি জনগণের আস্থা হ্রাস পাচ্ছে।
অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলায় অনেক মানুষ এখন চিকিৎসার খরচ কমিয়ে খাদ্য ও বাসস্থানের খরচ মেটাতে বাধ্য হচ্ছে।
সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঔষধ প্রশাসন অভিযোগ পেয়েছে, কিন্তু যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
সংস্থার পরিচালক আকতার হোসেন বলেছেন, ভোক্তারা লিখিত অভিযোগ করলে দাম পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিযোগের ভিত্তিতে সমাধান যথেষ্ট নয়, পুরো প্রক্রিয়ায় দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার প্রয়োজন।
সরকারি পর্যায়ে বাজার তদারকি বাড়াতে এবং উৎপাদকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থার অভাব রয়েছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আরও স্বচ্ছ, শক্তিশালী এবং স্বাধীন হতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণেও এই সমস্যা আরও গভীর হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ওষুধের কাঁচামাল আমদানি থেকে শুরু করে বাজারে বিতরণ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে নজরদারি প্রয়োজন।
উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়া হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
জনগণের দাবি ও সরকারকে করণীয়
সাধারণ মানুষ এখন সরকারের কাছে দ্রুত সমাধানের দাবি জানাচ্ছে।
কয়েকজন ভুক্তভোগী বলেছেন, ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া তারা বাঁচতে পারবেন না।
জনগণের চাপের মুখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখন একটি পুনর্বিবেচনা সভার আহ্বান করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য স্বতন্ত্র কমিটি গঠন করা যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার যদি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সক্ষমতা বাড়াতে না পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে আরও সংকট তৈরি হবে।
স্বাস্থ্যসেবায় সামগ্রিক সংস্কার, বাজার তদারকির উন্নয়ন এবং উৎপাদন খরচের স্বচ্ছ হিসাব নিশ্চিত করার ওপর জোর দিতে হবে।
ভোক্তাদের রক্ষায় আইন শক্তিশালী করা এবং ঔষধ প্রশাসনের ওপর সরকারের সরাসরি নজরদারি বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।
ওষুধের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ এবং অনিয়ন্ত্রিত মূল্য বৃদ্ধির রোধে সরকারকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সর্বোপরি, একটি সুসংগঠিত ও স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনার অভাব এই সংকটের মূল কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ও কার্যকর প্রশাসনিক সংস্কার ছাড়া এই সংকট থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়।