,

জাতীয় সরকারের গুঞ্জন: অন্তর্বর্তী সরকারের বৈঠক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশ বর্তমানে এক জটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

ছাত্র আন্দোলন, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতির মতো ইস্যুগুলো নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে।

অবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিতে এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় গত আগস্টে দায়িত্ব গ্রহণ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।

শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর এ সরকার দায়িত্ব নেয়।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন এবং দেশের অভ্যন্তরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের অভিযোগও পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে।

সংকট নিরসনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দল, ছাত্রনেতা ও ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছেন।

জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এখন প্রধান লক্ষ্য।

দ্বৈঠকসমূহের তথ্য

মঙ্গলবার থেকে বৈঠকের কার্যক্রম শুরু হয়।

প্রথম বৈঠকে অংশ নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।

তারা জাতীয় ঐক্যের অংশ হিসেবে একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন।

বুধবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক হয়।

বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং গণ অধিকার পরিষদের মতো দলগুলো বৈঠকে অংশ নেয়।

বৈঠকে জাতীয় সরকারের প্রস্তাব আসে।

নিরাপত্তা কাউন্সিল এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরিতে সবার সমন্বয়ের দাবি উঠে।

আজ বৃহস্পতিবার ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হবে।

ধর্মীয় সংগঠনগুলো ইতোমধ্যে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে।

তারা দেশের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সরকারের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত।

জামায়াতে ইসলামী তাদের আলোচনায় সরকারকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছে।

তারা জানান, অপপ্রচার রুখতে তারা কাজ করবে।

বৈঠকগুলোতে সহিংসতা বন্ধ এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।

জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে সংকট মোকাবেলার জন্য পরবর্তী পদক্ষেপের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছে।

তাদের মতে, নির্বাচন-পরবর্তী জাতীয় সরকারই স্থিতিশীলতার একমাত্র সমাধান।

তবে অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় সরকারের প্রস্তাবকে প্রাথমিকভাবে আলোচনা পর্যায়ে রাখতে চায়।

বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

তবে তারা মনে করেন, প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, জাতীয় নির্বাচন ছাড়া জাতীয় সরকার গঠনের আলোচনা অসম্পূর্ণ।

তিনি আরও জানান, নির্বাচন কমিশনের সময়সীমা অনুযায়ী নির্বাচন ২০২৬ সালে হতে পারে।

এটি সংকট আরও দীর্ঘায়িত করবে বলে তাদের আশঙ্কা।

অন্যদিকে, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর প্রস্তাব দেন, আগামী দুই বছরের জন্য জাতীয় সরকার গঠন করা হোক।

তিনি আরও বলেন, সংকট নিরসনে আগামী ছয় মাসের জন্য সব ধরনের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা উচিত।

জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে।

তাদের মতে, জাতীয় ঐক্য এবং নির্বাচনের রূপরেখা চূড়ান্ত হলে সংকটের ৮০ শতাংশ সমাধান হবে।

তারা জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে শান্তির পতাকা নিয়ে কর্মসূচি পালনের প্রস্তাব দিয়েছে।

জামায়াতে ইসলামীও জাতীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছে।

তারা স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে।

তবে দলগুলো নির্বাচন-পূর্ব এবং নির্বাচন-পরবর্তী জাতীয় সরকারের কাঠামো নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করছে।

বিএনপি নির্বাচন-পরবর্তী জাতীয় সরকারের পক্ষপাতী।

জামায়াতে ইসলামী এবং গণ অধিকার পরিষদ নির্বাচন-পূর্ব সরকারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে।

এমন অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টা সবাইকে আলোচনায় নিয়ে ঐকমত্য গঠনের চেষ্টা করছেন।

পরবর্তী অংশগুলোতে বর্তমান সংকট এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

চলমান সংকট ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে জটিল আকার ধারণ করেছে।

ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বেড়েছে।

শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে।

ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ অব্যাহত রয়েছে।

এই প্রতিবেদনগুলোর অনেকাংশই অতিরঞ্জিত এবং ভিত্তিহীন বলে অন্তর্বর্তী সরকার দাবি করেছে।

অবশ্য, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাম্প্রতিক হামলার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে।

ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলা এবং জাতীয় পতাকা পোড়ানোর ঘটনা দুই দেশের সম্পর্ককে আরও তিক্ত করেছে।

এই ঘটনার পর থেকেই ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েন চলমান।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সনাতনী সম্প্রদায়ও দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন হয়রানি এবং অপপ্রচারের শিকার হচ্ছে।

ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বজায় রাখতে অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও তাতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসেনি।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক সংকট আরও তীব্র হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভারতের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠা কঠিন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কূটনৈতিক টানাপড়েনের ফলে ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহায়তা এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন এবং আস্থার পরিবেশ তৈরি করা এখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ।

অন্তর্বর্তী সরকারের চ্যালেঞ্জ

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।

তবে, ক্ষমতার মাত্র ১০০ দিনের মধ্যেই সরকারের নানা ঘাটতি সামনে এসেছে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে সরকার এখনও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত হলেও সহিংসতা এবং দমন-পীড়নের অভিযোগ পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।

টিআইবি বলেছে, বিদ্যমান সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকারের আরও সময় লাগবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্র সংস্কার এবং নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তি তৈরি করা।

তবে, এখন পর্যন্ত এ কাজে যথেষ্ট অগ্রগতি দেখা যায়নি।

টিআইবির প্রতিবেদনে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারের অ্যাডহক প্রবণতার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

শিক্ষা খাত এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন খাতকে সংস্কারের আওতায় না আনার সমালোচনাও হয়েছে।

অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ঋণ শর্তাবলী নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করা হয়েছে।

বিশ্বব্যাংক, এডিবি, এবং আইএমএফের মতো সংস্থাগুলোর সহায়তার শর্তাবলী দেশের ওপর অতিরিক্ত ঋণের বোঝা চাপাতে পারে।

অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর জনগণের প্রত্যাশা এবং আন্তর্জাতিক চাপের ভার একই সঙ্গে পড়ছে।

সরকারের কঠোর পদক্ষেপ না নিলে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট আরও গভীর হতে পারে।

জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগকে সময়ের দাবি হিসেবে দেখছেন অনেক বিশ্লেষক।

রাজনৈতিক বিভাজন এবং সামাজিক উত্তেজনা ঠেকাতে জাতীয় ঐক্যই হতে পারে একমাত্র পথ।

ছাত্রনেতা, রাজনৈতিক দল এবং ধর্মীয় সংগঠনগুলো ইতোমধ্যেই জাতীয় ঐক্যের প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়েছে।

তবে, ঐক্য কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে এবং এর কাঠামো কী হবে, তা নিয়ে এখনও বিতর্ক রয়েছে।

বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন-পূর্ব এবং নির্বাচন-পরবর্তী সরকার নিয়ে ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে।

অন্যদিকে, গণ অধিকার পরিষদ জাতীয় সরকারের মাধ্যমে স্থায়ী সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্য হলো, সব পক্ষকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, জাতীয় ঐক্য ছাড়া স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।

তিনি আরও বলেছেন, বিভাজন যত গভীর হবে, দেশের সংকট তত জটিল আকার ধারণ করবে।

ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করতে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

সরকার ইতোমধ্যেই একটি রোডম্যাপ তৈরির কাজ শুরু করেছে।

জাতীয় সরকারের গঠনের প্রস্তাব এখনও আলোচনার পর্যায়ে থাকলেও এ বিষয়ে ইতিবাচক অগ্রগতি হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগ সফল হলে দেশের সংকট দ্রুত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

তবে, ব্যর্থ হলে রাজনৈতিক সহিংসতা এবং অর্থনৈতিক সংকট আরও গভীর হবে।

সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপগুলোই ঠিক করে দেবে দেশের সংকট সমাধানের পথ।

আরও পড়তে পারেন