সংগঠন নিষিদ্ধের পর থেকে গ্রেফতারের বিষয়ে কী বলছেন আইন বিশেষজ্ঞরা?
বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার পর থেকে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এই প্রেক্ষাপটে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের সদস্যদের গ্রেফতার করা যায় কি না, এ বিষয়ে আইনি বিশ্লেষণ করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীরা।
বাংলাদেশে সম্প্রতি গণঅভ্যুত্থান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ে ছাত্রলীগের সদস্যরা সহিংসতায় জড়িত থাকায় তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের হয়েছে।
আদালতেও এসব ঘটনায় দোষী প্রমাণিত হওয়ার মতো প্রমাণ রয়েছে বলে সরকারের দাবি।
তবে আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, সংগঠন নিষিদ্ধ করা হলেও কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অপরাধ ছাড়া শুধু সংগঠনের সদস্য হিসেবে গ্রেফতার করা যাবে না।
একই সঙ্গে, ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ থাকলেই অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা যাবে।
সরকার জানিয়েছে, সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষণার পর থেকে যদি কোনো ব্যক্তি সংগঠনটির নামে কর্মকাণ্ড চালায়, তবে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।
এতে ফৌজদারি অপরাধের ভিত্তিতে গ্রেফতার ও শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার
গত ২৪শে অক্টোবর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিদিনই ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করছে।
রাজধানী ঢাকায় যাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, পুলিশের পক্ষ থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তা জানানো হচ্ছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানিয়েছেন, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, তাদেরই গ্রেফতার করা হচ্ছে।
গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে একাধিক সহিংসতার অভিযোগ রয়েছে, এবং বিচারাধীন মামলার অংশ হিসেবেই তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪শে অক্টোবর থেকে ঢাকায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ও হল কমিটিসহ মোট ১২ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, হত্যাসহ বিভিন্ন সহিংস কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে করা মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন।
আইন অনুযায়ী কী বলা আছে?
গত ২৩শে অক্টোবর, বাংলাদেশ সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯’ অনুযায়ী সংগঠনটিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, নির্দিষ্ট কোনো অপরাধের অভিযোগ না থাকলে শুধুমাত্র নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের সদস্য হিসেবে কাউকে গ্রেফতার করা আইনসিদ্ধ নয়।
তিনি বলেন, ফৌজদারি অপরাধের ভিত্তিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে, তবে শুধুমাত্র সংগঠনের সদস্য হিসেবে থাকা কারণে নয়।
আরেকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সিহাব উদ্দিন খান মনে করেন, ছাত্রলীগের সদস্য হলেও শুধু এই পরিচয়ে কাউকে গ্রেফতার করা যায় না।
তিনি আরও বলেন, নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে যদি সংগঠনটির ব্যানারে কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়, তাহলে সেটি শাস্তির আওতায় আসবে।
কেন ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো?
সরকারের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ গণরুম কেন্দ্রিক নির্যাতন, সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজী, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ছিল।
এছাড়া, সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়েও তাদের বিরুদ্ধে সহিংস হামলার অভিযোগ এসেছে।
সরকার বলছে, সংগঠনটির অপরাধের পর্যাপ্ত প্রমাণ থাকায় ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এই নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষিতে, সংগঠনটি এখন কোনো ধরনের কর্মকাণ্ড চালাতে পারবে না।
শাস্তির বিধান কী?
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৭ ধারায় সন্ত্রাসী কাজ, ষড়যন্ত্র বা সহযোগিতার মাধ্যমে সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।
ফৌজদারি অপরাধের ভিত্তিতে বিচার হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা অন্য শাস্তির আওতায় আসতে পারেন।
আইন অনুযায়ী, সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষণার পর থেকে যদি সংগঠনটির নেতাকর্মীরা তাদের ব্যানারে কোনো ধরনের কার্যক্রম চালায়, তাহলে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ ধরনের অপরাধ দোষী প্রমাণিত হলে অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে সাজা নির্ধারণ করা হবে।
গ্রেফতার নিয়ে বিতর্ক ও মতামত
সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মীকে গ্রেফতারের ঘটনা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে।
ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সারজিস আলম এ গ্রেফতারের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, শুধুমাত্র সংগঠনের পদে থাকার জন্য কাউকে গ্রেফতার করা সমর্থনযোগ্য নয়।
তার মতে, ছাত্রলীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকলেও যদি কারও নির্দিষ্ট অপরাধের প্রমাণ না থাকে, তবে তাকে গণহারে গ্রেফতার করা উচিত নয়।
গ্রেফতারের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন অপরাধের নির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীরা মনে করেন, কোনো সংগঠন নিষিদ্ধ হলেও শুধুমাত্র সদস্য হওয়ার কারণে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না।
তবে সংগঠনটির নাম ব্যবহার করে সহিংস কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে।
সরকার ও পুলিশ কী বলছে?
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে কারণ এর নেতাকর্মীরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল।
পুলিশ বলছে, যাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার নির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, তাদেরই আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।
ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, “নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন যদি কোনো রকমের তৎপরতা চালায়, সেক্ষেত্রে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়।”
সরকার জানিয়েছে, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে সহিংসতার প্রমাণ থাকায় এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংগঠনটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
নিষিদ্ধ ঘোষণার পর পরবর্তী করণীয়
নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের জন্য কোনো ধরনের সংগঠনের ব্যানারে কার্যক্রম চালানো এখন অবৈধ।
যদি কোনো সদস্য সংগঠনটির নামে কার্যক্রম চালান, তবে তা আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, নিষিদ্ধ সংগঠনের কার্যক্রম ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান নেয়া প্রয়োজন।
তবে নির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া শুধুমাত্র সদস্য পরিচয়ে গ্রেফতার করা যেন না হয়, সেদিকেও গুরুত্ব দিতে হবে বলে মতামত দিয়েছেন তারা।
প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি
ছাত্রলীগের নিষিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের ফলে সরকারের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ আরও বাড়তে পারে।
সরকারের দাবি, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সংগঠনটি যদি তৎপর থাকে, তবে নিরাপত্তা ও আইনি ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করা হবে।
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের রাজনৈতিক পক্ষপাত যেন না হয়।
গ্রেফতারের ক্ষেত্রে আইন ও শৃঙ্খলার নীতিমালা যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে।
বাংলাদেশে ছাত্রলীগের নিষিদ্ধ হওয়ার ঘটনাটি সাম্প্রতিককালে রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় প্রভাব ফেলেছে, এবং এটি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।