চীন থেকে আবারও নতুন এক ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার খবর শোনা যাচ্ছে।
হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস বা এইচএমপিভি নামের এই ভাইরাস চীনের পাশাপাশি জাপান ও অন্যান্য দেশের হাসপাতালগুলোয় শ্বাসযন্ত্রজনিত রোগীর ভিড় বাড়াচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চীনের হাসপাতালগুলোতে রোগীদের ভিড় এবং অসুস্থ শিশুদের চিত্র দেখা যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাইরাসটি মূলত শিশু, গর্ভবতী এবং জটিল রোগে আক্রান্তদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
তবে এটি করোনাভাইরাসের মতো নতুন কোনো ভাইরাস নয়।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এইচএমপিভি আগে থেকেই বিদ্যমান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা চীনের সরকার এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক সতর্কতা জারি করেনি।
তবুও প্রশ্ন উঠেছে, এই ভাইরাসটি মহামারি রূপ নেবে কিনা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে সতর্ক থাকা উচিত।
এইচএমপিভি ভাইরাস: কী এটি এবং কেন তা গুরুত্বপূর্ণ?
এইচএমপিভি একটি আরএনএ ভিত্তিক ভাইরাস।
এটি শ্বাসযন্ত্রে আক্রমণ করে এবং জ্বর, সর্দি, কাশি, ও শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি করে।
২০০১ সালে প্রথম এই ভাইরাসটি আবিষ্কৃত হয় নেদারল্যান্ডসে।
তবে গবেষণায় দেখা গেছে, ভাইরাসটি অন্তত ৬০ বছর ধরে মানুষের মধ্যে বিদ্যমান।
চীনের সিডিসি বলছে, এইচএমপিভি সাধারণ শীতকালীন স্বাস্থ্য সমস্যার একটি উদাহরণ।
তবে কোভিড-১৯ ভাইরাসের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, কোভিডের টিকা বা এর বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রতিরোধ ক্ষমতা এইচএমপিভি থেকে সুরক্ষা দিতে পারে না।
বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞদের মতে, ভাইরাসটি ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো মৌসুমী রোগের কারণ হতে পারে।
তবে এটি গুরুতর আকার ধারণ করলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর চাপ তৈরি করতে পারে।
লক্ষণ: কারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে?
এই ভাইরাসের লক্ষণগুলো সাধারণ ফ্লুর মতো।
প্রথমে জ্বর, সর্দি, এবং নাকবন্ধ ভাব দেখা যায়।
এরপর কাশি, গলাব্যথা এবং শ্বাসকষ্ট শুরু হতে পারে।
কিছু ক্ষেত্রে ব্রংকাইটিস, নিউমোনিয়া বা অ্যাজমার মতো জটিল রোগ সৃষ্টি হতে পারে।
বিশেষত পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু, বয়স্ক, গর্ভবতী, এবং জটিল রোগে আক্রান্তরা বেশি ঝুঁকিতে।
ল্যানসেটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে মারা যাওয়া শিশুদের এক শতাংশের মৃত্যুর কারণ এই ভাইরাস।
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার বা সিওপিডির মতো রোগে আক্রান্তদের জন্য ভাইরাসটি আরও মারাত্মক হতে পারে।
এছাড়া শীতকালে এই ভাইরাসের প্রকোপ বেশি লক্ষ্য করা যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
চীনে পরিস্থিতি: হাসপাতালগুলোতে ভিড়
চীনের হাসপাতালগুলোতে শ্বাসযন্ত্রজনিত সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের ভিড় বাড়ছে।
রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম সিসিটিভি জানিয়েছে, শিশু রোগীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
১৪ বছরের কম বয়সী শিশুরা বিশেষভাবে আক্রান্ত।
জাপানে ইতিমধ্যে সাত লাখের বেশি মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে।
চীনের পাশাপাশি হংকং, ইন্দোনেশিয়া, এবং কম্বোডিয়াও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি করোনা মহামারির মতো ভয়াবহ হবে না।
তবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখা জরুরি।
কীভাবে ছড়ায় এই ভাইরাস?
এইচএমপিভি ছড়ানোর প্রধান মাধ্যম হলো সংক্রমিত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি।
আক্রান্ত ব্যক্তির নিঃশ্বাসের ড্রপলেটের সংস্পর্শে এলেই আরেকজন আক্রান্ত হতে পারে।
বিশেষ করে বন্ধ জায়গায় এই ভাইরাস দ্রুত ছড়ায়।
ড্রপলেট লেগে থাকা বস্তু যেমন দরজার হাতল, লিফটের বোতাম, বা খাওয়ার পাত্রের মাধ্যমে সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বাড়ে।
আক্রান্ত ব্যক্তি হাত দিয়ে নাক বা মুখ ঢেকে কাশি দিলে, সেই হাতের সংস্পর্শেও এই ভাইরাস ছড়ায়।
সংক্রমণের সম্ভাবনা শীত ও বসন্তকালে সবচেয়ে বেশি।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, জনসমাগম বা ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা এড়িয়ে চললে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব।
তবে সচেতন না হলে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রতিরোধের উপায়: কী করা উচিত?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ভাইরাস প্রতিরোধে করোনা মহামারির সময়ের সতর্কতাগুলোই কার্যকর।
মাস্ক পরা এবং নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
২০ সেকেন্ড ধরে সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়া সংক্রমণ রোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হাত দিয়ে মুখ, নাক বা চোখ স্পর্শ করা এড়িয়ে চলা উচিত।
হাঁচি বা কাশির সময় মুখ ঢাকতে টিস্যু ব্যবহার করা এবং সেটি নিরাপদ স্থানে ফেলে হাত পরিষ্কার করা জরুরি।
ভাইরাস প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক এবং জটিল রোগে আক্রান্তদের জন্য এসব সতর্কতা অপরিহার্য।
যদি কোনো ব্যক্তি জ্বর, সর্দি বা কাশিতে আক্রান্ত হন, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং চীনের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষও এই পরামর্শের সঙ্গে একমত।
চিকিৎসার অবস্থা: নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই
এইচএমপিভি চিকিৎসায় এখনো নির্দিষ্ট কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই।
চিকিৎসকরা সাধারণত রোগের লক্ষণ উপশমে মনোযোগ দেন।
জ্বর থাকলে তাপমাত্রা কমানোর ওষুধ এবং শ্বাসকষ্ট হলে ইনহেলার বা অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশ্রাম, পুষ্টিকর খাবার এবং পর্যাপ্ত পানি পানের মাধ্যমেই রোগী সেরে ওঠেন।
তবে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া জরুরি।
বিশেষ করে শিশু এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
চিকিৎসকরা অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে বলেছেন।
চীনের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভাইরাসটি সাধারণত নিজে থেকেই সেরে যায়।
তবে রোগীর অবস্থা যদি জটিল হয়, তাহলে শ্বাসযন্ত্রের সমস্যার চিকিৎসা প্রাধান্য পাবে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ: আতঙ্ক নয়, সতর্কতা
বিশ্বজুড়ে বিশেষজ্ঞরা এইচএমপিভি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই বলে মত দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল জানিয়েছে, এটি নতুন কোনো ভাইরাস নয়।
বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, ভাইরাসটি নিয়ে আগে থেকেই কিছুটা প্রতিরোধ ক্ষমতা মানুষের শরীরে রয়েছে।
তবে শিশু, গর্ভবতী এবং জটিল রোগে আক্রান্তদের জন্য এটি উদ্বেগের কারণ হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা ভাইরাসের লক্ষণগুলো দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
তারা সতর্ক করেছেন, শ্বাসকষ্ট বা তীব্র জ্বরের মতো উপসর্গগুলো অবহেলা করা উচিত নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখছে।
যতক্ষণ না পর্যন্ত ভাইরাসটি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে, ততক্ষণ আতঙ্ক নয়, বরং সতর্কতাই সবার জন্য যথেষ্ট।