চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি এবং কৌশলগত স্থাপনাগুলোর কেন্দ্রস্থল। এই বন্দরের টার্মিনালগুলোর দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানির হাতে দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। পিসিটি (পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল) এবং এনসিটি (নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল) পরিচালনায় বিদেশি কোম্পানিগুলোর অংশগ্রহণ কি কৌশলগত নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে, তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পিসিটি: সৌদি কোম্পানির পরিচালনায়
সরকার পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) চুক্তির আওতায় পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের (পিসিটি) দায়িত্ব দিয়েছে সৌদি আরবভিত্তিক রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল (আরএসজিটিআই) নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে।
২০২২ সালে লন্ডনে নিবন্ধিত এই প্রতিষ্ঠানটি ২২ বছরের কনসেশন চুক্তির আওতায় পিসিটি পরিচালনা করছে। ২০২৩ সালের জুনে তারা কার্যক্রম শুরু করে।
তবে এই কোম্পানির নিয়োগ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এই টার্মিনালের দায়িত্ব এমন একটি কোম্পানিকে দেওয়া হয়েছে যার পরিচালনা কাঠামোয় প্রতিবেশী একটি রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের প্রভাব রয়েছে।
আরএসজিটিআই-এর অভিজ্ঞতা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেকে। কারণ, প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মাত্র ২০২২ সালে, যখন জিটুজি চুক্তি আগেই স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
এনসিটি: অপারেটর নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক
নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), চট্টগ্রাম বন্দরের অন্যতম প্রধান টার্মিনাল। এটি নির্মাণ শুরু হয়েছিল ২০০০ সালের দিকে।
বর্তমানে এই টার্মিনাল পরিচালনা করছে দেশীয় অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক। তবে তাদের মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে।
সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এনসিটির পরিচালনার দায়িত্ব সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
বন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে একদিকে বিদেশি প্রভাব বাড়বে এবং অন্যদিকে কৌশলগত নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।
কৌশলগত নিরাপত্তার প্রশ্ন
পিসিটি এবং এনসিটির মধ্যবর্তী এলাকায় রয়েছে দেশের প্রধান তেল স্থাপনাগুলো এবং নৌবাহিনীর ঘাঁটি।
এই দুটি টার্মিনালের দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নজরদারির সুযোগ তৈরি হচ্ছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, অর্থনৈতিক লাভের কথা ভেবে যদি কৌশলগত নিরাপত্তাকে অবহেলা করা হয়, তাহলে তা দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।
প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের দাবি
এনসিটির পরিচালনার দায়িত্ব একটি অপারেটরকে না দিয়ে, প্রতিটি জেটি আলাদা আলাদা অপারেটরকে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন অনেকে।
তাদের মতে, এতে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং একক আধিপত্যের অবসান হবে। একইসঙ্গে টার্মিনালের কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তাও বাড়বে।
নীতিমালা ও নজরদারির ঘাটতি
বন্দর ব্যবহারকারীরা অভিযোগ করেছেন যে, বিদেশি অপারেটর নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নীতিমালা এবং প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে না।
তারা বলছেন, জিটুজি চুক্তির মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, যেখানে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান করা হলে দেশীয় কোম্পানিগুলোও অংশ নিতে পারত।
আজকের বৈঠক
চট্টগ্রাম বন্দরের এই বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে আজ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক নিশ্চিত করেছেন যে তিনি এই বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন।
বন্দর ব্যবহারকারীরা আশা করছেন, বৈঠকে কৌশলগত নিরাপত্তা এবং বিদেশি প্রভাবের বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হবে।
ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ
পিসিটি ইতোমধ্যে বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
এনসিটির দায়িত্বও যদি বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়া হয়, তাহলে দেশের কৌশলগত স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা কতটা সুরক্ষিত থাকবে, তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, বিদেশি কোম্পানিগুলোর আধিপত্যের ফলে দেশের বন্দর ব্যবস্থাপনার উপর সরকার কতটা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে, তা এখন দেখার বিষয়।