বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপে সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের মুখে আতঙ্ক
বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের নির্বিচারে হামলা ও গুলিতে সাধারণ শিক্ষার্থী এবং নিরীহ লোকজন নিহত হওয়ার অভিযোগে পুলিশের সাবেক এবং বর্তমান অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব মামলার পর, আত্মগোপনে চলে গেছেন অনেক পুলিশ কর্মকর্তা। এর মধ্যে অন্তত ৯০ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশের একটি সূত্র।
ইতিমধ্যে সাবেক দুইজন ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) সহ ১০ থেকে ১২ জন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বর্তমান ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারা গ্রেপ্তারের ভয়ে আছেন বলে জানা গেছে।
অনুপস্থিত অনেক কর্মকর্তা এবং সদস্যকে বরখাস্ত করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতিমধ্যে এই কর্মকর্তাদের কর্মস্থলে যোগ দিতে নির্দেশ দিয়েছে, তবে তাদের বেশিরভাগই এখনো কাজে যোগ দেননি। পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ১৮৭ জন কর্মকর্তা এবং সদস্য এখনো কর্মস্থলে অনুপস্থিত। এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মামলার আসামি আত্মগোপনে, গ্রেপ্তারের আতঙ্কে পুলিশ
পুলিশের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলোর অধিকাংশ আসামি এখন আত্মগোপনে রয়েছেন। পুলিশের অভ্যন্তরীণ একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সরাসরি অংশ নিয়ে কিংবা নির্দেশনা দিয়ে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা বিভিন্ন স্থানে গুলি চালানোর আদেশ দিয়েছিলেন। এই মামলাগুলোর বেশিরভাগই ওই ঘটনায় নিহত হওয়া ছাত্র-জনতার পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে দায়ের করা হয়েছে।
এদিকে, এই মামলাগুলোতে অভিযুক্ত বেশ কিছু শীর্ষ কর্মকর্তার মধ্যে বর্তমানে পুলিশে কর্মরত আছেন এমন ব্যক্তিরাও রয়েছেন। এর ফলে বর্তমান এবং সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।
গ্রেপ্তারের তালিকায় থাকা পুলিশ সদস্যদের বেশিরভাগই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে প্রায় ৫০টির বেশি মামলা দায়ের হয়েছে বলে জানা গেছে।
আত্মগোপনে থাকা পুলিশ কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ
সরকারের শীর্ষ মহলে এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সিনিয়র সচিবদের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে, আত্মগোপনে থাকা পুলিশের মামলার আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করার বিষয়ে মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী একটি সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, “পুলিশের যেসব সদস্য এখনো কাজে যোগ দেননি, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। আমরা তাদেরকে পুলিশ হিসেবে গণ্য করবো না, বরং ক্রিমিনাল হিসেবে দেখবো।”
পুলিশের সূত্র মতে, বর্তমানে মোট ১৮৪ জন কর্মকর্তা এবং সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, যার মধ্যে দুইজন সাবেক আইজিপি রয়েছেন। মামলাগুলোর মধ্যে অনেকগুলো সরাসরি হত্যার অভিযোগে দায়ের করা হয়েছে।
শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা
ঢাকায় এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মামলা দায়ের হয়েছে সাবেক ডিবি কমিশনার হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে ৫০টিরও বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এছাড়াও ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ৩৭টি এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে ৪১টি মামলা হয়েছে। অন্যদের মধ্যে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের বিরুদ্ধে ২৯টি এবং ডিবির এসআই অমিতাভ দর্জির বিরুদ্ধে চারটি মামলা রয়েছে।
মামলাগুলো মূলত ৫ আগস্ট ও তার আগে ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনায় করা হয়েছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পুলিশের দায়ের করা মামলাগুলোর তদন্ত চলছে।
সাবেক দুই আইজিপির গ্রেপ্তার
ইতিমধ্যে সাবেক দুই আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এবং এ কে এম শহীদুল হকসহ বেশ কিছু শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই ক্ষমতাসীন সরকারের সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তারা রাজনৈতিক নির্দেশনা অনুযায়ী আন্দোলন দমনে অবৈধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। পুলিশের এই শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন তাদের প্রভাবের কারণে অনেকদিন ধরে মামলার মুখোমুখি হওয়া এড়িয়ে গিয়েছিলেন।
তবে বর্তমানে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে, পলাতক পুলিশ কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সক্রিয় থাকা কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার গতিবিধি অনুসরণ করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।
কর্মস্থলে অনুপস্থিত পুলিশ সদস্যদের বরখাস্তের প্রক্রিয়া শুরু
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থেকে অনুপস্থিত পুলিশ সদস্যদের কাজ শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হলেও, অনেক পুলিশ সদস্য এখনও কর্মস্থলে যোগ দেননি। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১৮৭ জন সদস্য বর্তমানে কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন।
এই অনুপস্থিতি এবং আত্মগোপনের কারণে সরকারের শীর্ষ মহল থেকে তাদের বরখাস্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে, দ্রুত সময়ের মধ্যে এই বরখাস্ত কার্যক্রম শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কিছু পুলিশ কর্মকর্তা, যারা হত্যার মামলায় অভিযুক্ত, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে কনস্টেবল থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত
গত সোমবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা খুব শীঘ্রই ৬৪টি জেলায় তিন হাজারের বেশি পুলিশ কনস্টেবল এবং এক হাজারের বেশি সাব-ইন্সপেক্টর নিয়োগ করবো।”
তিনি আরও জানান, আত্মগোপনে থাকা মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্ত অব্যাহত থাকবে এবং তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করার জন্য বিশেষ প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
যারা পুলিশে থেকে জনগণের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করেন, অথচ জনগণের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে পদক্ষেপ নেন, তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
আনসার, পুলিশ ও বিজিবির নতুন নিয়োগ
বর্তমানে পুলিশের বিরুদ্ধে যেসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তাদের জায়গায় নতুন নিয়োগ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। আনসার, পুলিশ এবং বিজিবি থেকে নতুন করে সদস্য নিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে।
এই নিয়োগের মাধ্যমে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও উন্নত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে স্বচ্ছ ও পেশাদার করার লক্ষ্যে নতুন নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।
গ্রেপ্তার আতঙ্কে শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তারা
পুলিশের শীর্ষ মহলের কর্মকর্তারা বর্তমানে গ্রেপ্তার আতঙ্কে ভুগছেন। যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তারা নিজেদের আত্মগোপনে রেখেছেন এবং এই মামলার তদন্ত এবং গ্রেপ্তারের হাত থেকে বাঁচতে চেষ্টা করছেন।
তবে সরকার এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো আত্মগোপনে থাকা কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করতে বদ্ধপরিকর। কর্মকর্তাদের মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে পুলিশের শীর্ষ মহলে এক ধরণের আতঙ্ক এবং অস্থিরতা বিরাজ করছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে এবং আত্মগোপনে থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ভবিষ্যতে আরও কঠোর ব্যবস্থা
পুলিশ বাহিনীতে শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে সরকার আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। যারা আত্মগোপনে রয়েছেন, তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করার পরিকল্পনা রয়েছে।
পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি প্রক্রিয়া আরও জোরদার করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়াতে, পুলিশ বাহিনীতে আরও পেশাদার এবং সৎ কর্মকর্তাদের নিয়োগের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শক্তিশালী করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।