র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র‍্যাব
,

গুম তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন: রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সম্পৃক্ততায় ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র উঠে এলো

বাংলাদেশের গুম তদন্ত কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে জোরপূর্বক গুম ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের ভয়াবহ বিবরণ।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে ১,৬৭৬টি গুমের অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে পর্যালোচনা করা হয়েছে ৭৫৮টি ঘটনা।

প্রতিটি ঘটনায় ভিকটিমদের ওপর পরিকল্পিত এবং সুশৃঙ্খল নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছে কমিশন।

গুম ও নির্যাতনের বিবরণ

প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি রোমহর্ষক নির্যাতনের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে।

ঢাকার ধানমন্ডি থেকে এক যুবককে তুলে নিয়ে ঠোঁট সেলাই করা হয় অ্যানেসথেসিয়া ছাড়াই।

এক ভিকটিমের কানে এবং যৌনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়, যা তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে ভয়ানক প্রভাব ফেলে।

আরেক ভিকটিম নদীতে ঝাঁপিয়ে পালানোর চেষ্টা করলে তাকে উদ্ধার করে ঘটনাস্থলেই হত্যা করা হয়।

এই ধরনের নির্যাতনকে ‘পরিকল্পিত এবং পদ্ধতিগত’ বলে চিহ্নিত করেছে কমিশন।

কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, গুমের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে ২০১৬ সালে।

সেই বছর ১৩০টি গুমের অভিযোগ জমা পড়ে।

২০২৪ সালে এ সংখ্যা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ২১টিতে।

গুমের প্রতিটি অভিযোগে চারটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেছে, যা এই ঘটনাগুলোকে গুম হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে।

এই বৈশিষ্ট্যগুলো হলো স্বাধীনতা হরণ, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টতা, ভিকটিমের অবস্থান গোপন রাখা এবং কোনো আইনি সুরক্ষা না দেওয়া।

গুমের ঘটনায় ভিকটিমদের পাঁচটি ধাপে নির্যাতন করা হতো।

প্রথম ধাপে ছিল টার্গেট নির্বাচন, এরপর নজরদারি।

তৃতীয় ধাপে ভিকটিমকে অপহরণ করে গোপন স্থানে নিয়ে আটকে রাখা হতো।

এরপর শুরু হতো শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন।

শেষ ধাপে নির্যাতন শেষে ভিকটিমকে হত্যা করা বা সমাজ থেকে চিরতরে সরিয়ে ফেলা হতো।

টার্গেট নির্ধারণ ও অপহরণ প্রক্রিয়া

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাউকে গুমের টার্গেট করার জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হতো।

মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং এবং নজরদারি করে ভিকটিমের দৈনন্দিন গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হতো।

এই কাজে ডিজিএফআই-এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টার (এনএমসি) এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) ভূমিকা রাখত।

নজরদারির তথ্যের ভিত্তিতে পরিকল্পনা করা হতো অপহরণের সময় এবং স্থান।

অপহরণের কাজটি সাধারণত রাতের বেলা করা হতো।

ভিকটিমকে তার বাড়ি থেকে বা রাস্তা থেকে তুলে নেওয়া হতো।

সাদা পোশাকধারী অপহরণকারীরা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে পরিচয় দিত।

তারা ভিকটিমকে “হায়েস” ধরনের বড় গাড়িতে তুলে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে সরে যেত।

গাড়িতে তোলার পরপরই ভিকটিমের চোখ বাঁধা হতো এবং তাকে হাতকড়া পরানো হতো।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই অপহরণ প্রক্রিয়া এত দ্রুত ঘটত যে আশেপাশের মানুষ কিছু বুঝে উঠতে পারত না।

অনেক সময় অপহরণকারীরা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে এক সংস্থার নাম ব্যবহার করে অন্য সংস্থার কাজ করত।

উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) নিজেদের র‍্যাব হিসেবে পরিচয় দিত।

অন্যদিকে র‍্যাব নিজেদের ডিজিএফআই হিসেবে পরিচয় দিত।

কমিশনের মতে, অপহরণ ছিল পুরো গুম প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ।

এরপর শুরু হতো ভয়ঙ্কর নির্যাতনের পালা।

আটক ও গোপন কারাগারে নির্যাতন

অপহরণের পর ভিকটিমকে নিয়ে যাওয়া হতো গোপন স্থানে।

এসব স্থানের মধ্যে কয়েকটি ছিল ডিজিএফআই, র‍্যাব এবং সিটিটিসি পরিচালিত গোপন কারাগার।

কমিশনের তদন্তে জানা গেছে, বাংলাদেশে আটটি গোপন কারাগারের অস্তিত্ব রয়েছে।

ঢাকা এবং চট্টগ্রামের এসব কারাগারের কাঠামোগত নকশায় মিল পাওয়া গেছে।

কমিশন মনে করে, গুম ও নির্যাতনের পুরো প্রক্রিয়া একটি কেন্দ্র থেকে পরিকল্পনা এবং তদারকি করা হতো।

ভিকটিমদের আটকে রাখা হতো অন্ধকার ও সাউন্ডপ্রুফ কক্ষে।

সেখানে তাদের ওপর চালানো হতো ভয়ানক নির্যাতন।

নির্যাতনের পদ্ধতিগুলোর মধ্যে ছিল পেটানো, বৈদ্যুতিক শক, এবং মানসিক নির্যাতন।

এসব নির্যাতনের জন্য বিশেষভাবে তৈরি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হতো।

এক ভিকটিমের অভিযোগ অনুযায়ী, তাকে ধানমন্ডি থেকে তুলে এনে ঠোঁট সেলাই করা হয়।

আরেক ভিকটিম জানান, তাকে যৌনাঙ্গে এবং কানে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়েছিল।

নির্যাতনের সময় ভিকটিমদের কাছ থেকে অন্যদের তথ্য বের করার চেষ্টা করা হতো।

কমিশন গোপন কারাগারের বিষয়ে আরও গভীর তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।

তদন্তে উঠে এসেছে, এসব কারাগারের অনেকগুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।

কিছু কারাগার এখনো অক্ষত অবস্থায় রয়েছে।

আটকের পর কিছু ভিকটিমকে হত্যা করা হয়েছে।

অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন।

আবার অনেক ভিকটিমকে নির্যাতনের পর কোনো অভিযোগ ছাড়াই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও গুমের পেছনের উদ্দেশ্য: ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কৌশল

বাংলাদেশে গুম ও জোরপূর্বক নিখোঁজের ঘটনা একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গুমের শিকারদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন বিরোধী দলের নেতা-কর্মী বা সরকারের সমালোচক।

এ ঘটনাগুলো রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন এবং সরকারবিরোধী আন্দোলন নস্যাৎ করার কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকে ক্ষমতাসীন দলের সমালোচনায় সোচ্চার ছিলেন।

তাদের মধ্যে অনেকেই ব্লগার, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী এবং সমাজকর্মী ছিলেন।

কমিশন উল্লেখ করেছে, বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের পাশাপাশি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ এবং ধর্মীয় সংগঠনের নেতারাও এই প্রক্রিয়ার শিকার হয়েছেন।

বিশেষ করে ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বিরোধী দল বিএনপির শতাধিক নেতা-কর্মীকে গুম করা হয়েছে।

এই সময়কালে সরকার বিরোধী আন্দোলন কঠোরভাবে দমনে উঠেপড়ে লেগেছিল।

বিরোধীদের আন্দোলন ঠেকাতে পরিকল্পিতভাবে গুম ও ভয়ভীতি প্রদর্শন চালানো হয়েছে।

কমিশনের মতে, গুমের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বিরোধী দলগুলোর সাংগঠনিক কাঠামো দুর্বল করা।

যেসব এলাকায় বিরোধী দল শক্তিশালী ছিল, সেখানকার নেতাদের গুম করে ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করা হয়।

পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়ায় যে অনেক বিরোধী নেতা-কর্মী গা-ঢাকা দিতে বাধ্য হন।

রাষ্ট্রের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে এই কৌশল কার্যকর ছিল বলে মনে করছে কমিশন।

তারা বলেছে, গুমের ভয়াবহতা শুধু ব্যক্তি নয়, পুরো সমাজকে প্রভাবিত করেছে।

সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

গুমের মাধ্যমে সরকার শুধু বিরোধীদের দমন নয়, আন্তর্জাতিক সমালোচনা থেকেও বাঁচতে চেয়েছে।

গুমের পর ভিকটিমদের আর খুঁজে না পাওয়ায় প্রমাণের অভাবে অনেক সময় মামলা হয়নি।

এতে সরকারের পক্ষে দায় এড়ানো সহজ হয়েছে।

আন্তর্জাতিক চাপ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন

বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুমের ঘটনায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন বারবার বাংলাদেশ সরকারকে এই বিষয়ের জন্য জবাবদিহির আহ্বান জানিয়েছে।

গুমের ঘটনা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও জাতিসংঘের গুম বিরোধী কনভেনশনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।

এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশে গুমের ঘটনার বিষয়ে কঠোর মনোভাব দেখিয়েছে।

২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)-এর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

তারা জানিয়েছিল, র‍্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে বহু গুমের অভিযোগ রয়েছে।

এই নিষেধাজ্ঞার ফলে বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ আরও বাড়ে।

জাতিসংঘের একটি বিশেষ প্রতিনিধি দলও গুম তদন্ত কমিশনের সঙ্গে তাদের উদ্বেগ শেয়ার করেছে।

তারা বলেছে, গুমের ঘটনা শুধুমাত্র ব্যক্তি অধিকার লঙ্ঘন নয়; এটি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি।

জাতিসংঘের মতে, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর ভূমিকা থাকায় গুমের শিকার ব্যক্তিদের ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা কম।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার এই ঘটনাগুলোর বিচার চেয়ে আসছে।

তারা বলেছে, গুমের ঘটনা বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী স্বচ্ছ তদন্ত প্রয়োজন।

কমিশন জানিয়েছে, গুমের বিচার না হওয়া একটি ভয়াবহ দৃষ্টান্ত তৈরি করছে।

বাংলাদেশ সরকার যদিও আন্তর্জাতিক চাপকে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেছে, কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার নজির কম।

বেশিরভাগ গুমের ঘটনা তদন্তে অগ্রগতি হয়নি।

অনেক ক্ষেত্রে পরিবারগুলো মামলা করলেও সেগুলো ন্যায়বিচারের মুখ দেখেনি।

কমিশনের সুপারিশ: ন্যায়বিচারের জন্য পথ খোঁজা

গুম তদন্ত কমিশন তাদের প্রতিবেদনে সরকারের প্রতি বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছে।

প্রথমত, কমিশন বলেছে, গুমের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা জরুরি।

গুমের শিকার পরিবারগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনেরও সুপারিশ করেছে তারা।

প্রতিবেদনে গুমের ঘটনায় জড়িত সংস্থাগুলোর দায়িত্ব ও ভূমিকা পর্যালোচনা করার কথা বলা হয়েছে।

কমিশন বলেছে, গুমের ঘটনা বন্ধ করতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

গুম এবং জোরপূর্বক নিখোঁজের ক্ষেত্রে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছে তারা।

তারা বলেছে, গুমের ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় না আনার সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে হবে।

গুম প্রতিরোধে একটি নিরপেক্ষ এবং শক্তিশালী নজরদারি সংস্থা গঠনের প্রস্তাবও দিয়েছে কমিশন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুম বন্ধ করতে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সংস্কার প্রয়োজন।

যেসব সংস্থা এই ধরনের কার্যক্রমে জড়িত, তাদের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

গুমের অভিযোগের তদন্ত করতে একটি স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ কমিশন গঠনেরও প্রস্তাব এসেছে।

কমিশন আরও বলেছে, জাতিসংঘের গুম বিরোধী কনভেনশনে দ্রুত সই করা উচিত।

এটি বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চলতে বাধ্য করবে।

প্রতিবেদনে গুমের শিকার পরিবারগুলোর সঙ্গে মানবিক আচরণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

গুমের শিকার পরিবারগুলোকে মানসিক এবং আইনি সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।

তারা বলেছে, ভিকটিমদের পরিবার যেন বিচার পাওয়ার প্রক্রিয়ায় বাধার সম্মুখীন না হয়।

গুম তদন্ত কমিশন বলেছে, এই ঘটনাগুলো শুধুমাত্র অপরাধ নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় নীতির ব্যর্থতার প্রতিফলন।

তারা মনে করে, গুমের ঘটনা বন্ধ করা ছাড়া বাংলাদেশে ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।

আরও পড়তে পারেন