গুমের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ২২ সদস্যের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারির সুপারিশ করেছে গুম তদন্ত কমিশন।
কমিশনের এক সদস্য জানিয়েছেন, এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের স্বার্থে গত নভেম্বরে সরকারকে এমন সুপারিশ করা হয়েছে।
এই ২২ কর্মকর্তার মধ্যে রয়েছেন ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফরসেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), এবং পুলিশের সদস্যরা।
তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন
কমিশনের এক সদস্য বলেছেন, গুমের অভিযোগে তদন্তের জন্য এই কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।
তিনি জানিয়েছেন, কমিশন প্রাথমিক তদন্তে তাদের গুমের ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে।
তবে ওই কর্মকর্তারা কখন এবং কিভাবে গুমের ঘটনায় যুক্ত ছিলেন, সেই তথ্য এখনই প্রকাশ করা হচ্ছে না।
তিনি আরও জানান, তদন্তের স্বার্থে ইমিগ্রেশন বিভাগকে সতর্ক করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
“তথ্য প্রকাশ করা সম্ভব নয়”: কমিশন
এই বিষয়ে আরেক কমিশন সদস্য নাবিলা ইদ্রিস বলেন, “আমি এই বিষয়ে কিছু স্বীকার বা অস্বীকার করছি না। তদন্তের স্বার্থে আমরা কোনো তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ করছি না।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা আমাদের হালনাগাদ তথ্য প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে জানাব।”
এদিকে, গুজব ছড়িয়েছে যে অভিযুক্ত এই ২২ কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
“বহিষ্কারের খবর ভুয়া”: কমিশন
কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যকে কমিশনের সুপারিশে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়নি।
রবিবার সন্ধ্যায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, এই ধরনের খবর ভুয়া।
১৬০০ অভিযোগ জমা, আরও আসছে
১৭ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস বলেন, কমিশনে ইতোমধ্যে ১,৬০০-এর বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে।
তিনি আরও জানান, অভিযোগের সংখ্যা ৩,৫০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে তিনি ধারণা করছেন।
এর আগে ৫ নভেম্বর কমিশন জানায়, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনায় ১,৬০০ ভুক্তভোগীর অভিযোগ জমা পড়েছে।
গুমের ঘটনাগুলো
সেপ্টেম্বর ১৫ থেকে অক্টোবর ৩১ পর্যন্ত ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবার কমিশনে অভিযোগ জমা দিয়েছেন।
কমিশন জানিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং নিরাপত্তা সংস্থার অফিসে আটটি গোপন আটককেন্দ্রের খোঁজ পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে অন্যতম রাজধানীর ডিজিএফআই সদর দফতরের যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্র, যা “আয়নাঘর” নামে পরিচিত।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে গুম হওয়া প্রায় ২০০ ব্যক্তি এখনও নিখোঁজ রয়েছেন।
কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, গুমের শিকার হওয়া ১,৪০০ জনের বেশির ভাগকেই পরবর্তীতে অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগে মামলা দিয়ে ফাঁসানো হয়।
তাদের মধ্যে অনেককে কারাগারে পাঠানো হয়েছে, বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে, এমনকি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
তবে অনেকেই জামিনে মুক্তি পেয়েছেন এবং বহু মামলার কার্যক্রম এখনও চলমান।
কমিশনের সুপারিশের প্রতিক্রিয়া
গুম তদন্ত কমিশনের এই সুপারিশ দেশের রাজনীতিতে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো কমিশনের কাজকে স্বাগত জানালেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে নেওয়া ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গুমের ঘটনা এবং এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে সরকারকে আরও দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।
এদিকে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
গুমের ঘটনাগুলোর পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দাবিতে মানবাধিকার কর্মীরা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
এই সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে এটি দেশের বিচারিক ব্যবস্থার জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে।