বাংলাদেশ পুলিশ
,

গণপিটুনির উদ্বেগজনক প্রবণতা: পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুলিশের ভূমিকা এবং আইনের বাস্তবায়ন

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর গণপিটুনির ঘটনা ক্রমশ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এই ধরনের সহিংসতা বিশেষত জনগণের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতাকে সামনে নিয়ে এসেছে। জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে, গণপিটুনির প্রবণতা অপরাধ দমনে পুলিশের ব্যর্থতা ও সমাজে আইনের প্রতি আস্থার ঘাটতি প্রকাশ করছে। কখনও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, কখনও ধর্ম অবমাননার অভিযোগ, আবার কখনও চুরির সন্দেহে মানুষদের নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা দেখা যাচ্ছে। এই ধরনের ঘটনাগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো সতর্কতা জারি করেছে।

গণপিটুনির সাম্প্রতিক ঘটনা: উদ্বেগ বাড়ছে

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বেশ কয়েকটি গণপিটুনির ঘটনা সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে উঠে এসেছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে এক ব্যক্তিকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা জনমনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। মৃত ব্যক্তি, তোফাজ্জল নামে এক ব্যক্তি, চোর সন্দেহে হলে প্রবেশ করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাকে আটক করে রাতভর মারধর করে এবং পরে তার মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।

এছাড়া, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদকেও গণপিটুনির শিকার হতে হয়েছে। তার মৃত্যুর ঘটনাও নতুন করে গণপিটুনির ভয়াবহতা প্রমাণ করে। রাজনৈতিক প্রভাব কিংবা ব্যক্তি বিরোধের জন্য গণপিটুনি দেয়ার সংস্কৃতি বাংলাদেশে অনেক দিন ধরেই রয়েছে, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এর প্রকোপ বেড়ে গেছে বলে মানবাধিকার কর্মীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদের গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। তাকে ধরে মারধর করা এবং তার জীবন রক্ষা করতে না পারার করুণ চিত্র বিভিন্ন ভিডিওতে ধরা পড়েছে। এর আগে, তিনি ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও সেসব কর্মকা‍ণ্ড অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে তিনি দাবি করেছিলেন।

গণপিটুনির পেছনের কারণ ও প্রভাব

গণপিটুনির প্রবণতা মূলত গুজব, জনমনে জমে থাকা ক্ষোভ এবং সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। বিশেষ করে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পরিস্থিতি অনেকাংশে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। বেশ কয়েকটি সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সহিংস ইতিহাস এবং পুলিশের আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুর্বলতার কারণে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার সাহস পাচ্ছে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানায়, গত ছয় বছরে গণপিটুনিতে প্রায় ২৮৬ জন নিহত হয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছেলেধরা সন্দেহ, চুরি বা ডাকাতির মতো অপরাধের অভিযোগে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। গুজব, সামাজিক অস্থিরতা ও আইনের প্রয়োগের অভাব এই ধরনের সহিংস ঘটনার সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা গেছে, ৫ই আগস্টের পর থেকে দেশজুড়ে ২১ জনের গণপিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে। বগুড়া, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, টঙ্গীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

মানবাধিকার কর্মীদের উদ্বেগ

মানবাধিকার কর্মী নূর খান মনে করেন, গণপিটুনি বাংলাদেশে একটি গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা। তিনি বলেন, “গত ১৫/১৬ বছর ধরে বাংলাদেশে স্বৈরশাসন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দমন-পীড়নের কারণে মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। জনগণের মনোবল ভেঙে পড়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং বিচারব্যবস্থার উপর আস্থা কমে গেছে। ফলে মানুষ এখন নিজের হাতে বিচার নেওয়ার চেষ্টা করছে।”

তিনি আরও বলেন, “গণপিটুনি যেমন রাষ্ট্রের ব্যর্থতার প্রতীক, তেমনি এটি সমাজের মনস্তাত্ত্বিক অসুস্থতারও প্রতিফলন। জনগণ বিচারব্যবস্থার উপর আস্থা হারিয়ে নিজেদেরকেই বিচারকের আসনে বসাচ্ছে, যা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য বিপজ্জনক।”

মানবাধিকার কর্মীরা সতর্ক করে দিচ্ছেন যে, পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়, তবে এই ধরনের সহিংসতা আরও বাড়তে পারে। এর ফলে সমাজে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকবে।

পুলিশের ভূমিকা এবং তদন্তের দুর্বলতা

বেশ কয়েকটি গণপিটুনির ঘটনায় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা এবং তদন্তে দুর্বলতার অভিযোগ উঠেছে। বিশেষত পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে যেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে গণপিটুনির ঘটনা ঘটলেও মামলা নেয়া হচ্ছে অনেক পরে, এবং তদন্তে গাফিলতির কারণে অপরাধীরা শাস্তি পাচ্ছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তোফাজ্জল হত্যার ঘটনায় পুলিশের প্রতিক্রিয়া যথাযথ ছিল না বলে সমালোচকরা মনে করেন। গণপিটুনির শিকার হওয়ার পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে তার মৃত্যু হয়। পুলিশি তদন্তে কোনো ধরনের সঠিক প্রমাণ উপস্থাপন না করায় এই ধরনের ঘটনা বিচারের মুখোমুখি হতে পারছে না।

মানবাধিকার সংস্থার মতে, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি এই ধরনের ঘটনার সময় উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারে না, তাহলে জনমনে একটি নেতিবাচক বার্তা যায়। অপরাধীরা ধরে নেয় যে, তারা কোনো রকম শাস্তি ছাড়াই পার পেয়ে যাবে, এবং গণপিটুনির মতো সহিংসতা অব্যাহত থাকে।”

সংবিধান ও আইনের প্রয়োগের ঘাটতি

বাংলাদেশের সংবিধানে প্রতিটি নাগরিকের আইনের আশ্রয় পাওয়ার এবং ন্যায্য বিচার লাভের অধিকার রয়েছে। সংবিধানের ৩৫ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে অপরাধী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করার আগে তাকে আইনের সামনে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। এছাড়া, ফৌজদারি কার্যবিধিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কেউ অপরাধে জড়িত সন্দেহ হলে তাকে পুলিশে হস্তান্তর করা বাধ্যতামূলক।

কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, আইন নিজ হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটলেও অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। গণপিটুনিতে যুক্ত ব্যক্তিদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রেপ্তার করা হয় না, এবং গ্রেপ্তার হলেও বিচারকাজ ধীরগতিতে চলার কারণে শাস্তি নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে।

গণপিটুনির ফলে মৃত্যুর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারা অনুযায়ী শাস্তির বিধান রয়েছে, কিন্তু প্রকৃত শাস্তি খুব কমই কার্যকর হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রতিক্রিয়া

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও বাংলাদেশে গণপিটুনির এই উদ্বেগজনক প্রবণতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা (UNHCR) এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বারবার বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে গণপিটুনির ঘটনায় যথাযথ তদন্ত এবং বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করতে।

মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা (UDHR) অনুসারে, প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনের অধিকার রয়েছে এবং কাউকে শারীরিক বা মানসিকভাবে নির্যাতন করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে, এই ধরনের সহিংসতা বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।

সামাজিক সচেতনতা এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা

গণপিটুনি রোধে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে সঠিক তথ্য প্রচার এবং গুজব নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে অনেকাংশে এই সহিংসতা রোধ করা সম্ভব হতে পারে।

২০১৯ সালের বাড্ডায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত তাসলিমা বেগম রেণুর মৃত্যুর পর আদালত গণপিটুনি রোধে পাঁচ দফা নির্দেশনা জারি করেছিল। এর মধ্যে রয়েছে—পুলিশের প্রতিটি সার্কেল অফিসার তার অধীনে থানাগুলোর সাথে গণপিটুনির প্রবণতা নিয়ে বৈঠক করবে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ঠেকাতে পদক্ষেপ নেবে।

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।

সরকারের প্রতিক্রিয়া

সাম্প্রতিক গণপিটুনির ঘটনায় সরকারও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, তবে এ ব্যাপারে আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা। গণপিটুনি ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে সামাজিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে।

আরও পড়তে পারেন