বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য গত বছর ছিল আর্থিকভাবে অত্যন্ত কষ্টকর। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম লাগামহীন হয়ে পড়েছিল, যা সাধারণ মানুষকে চরম বিপাকে ফেলে দেয়। তবে চলতি বছর পরিস্থিতি আরও কঠিন হতে চলেছে।
সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে শতাধিক পণ্য ও সেবায় নতুন শুল্ক ও কর আরোপ করা হয়েছে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়িয়ে তুলবে। অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক মহল পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেছেন।
মূল্যস্ফীতির চাপ: মানুষের অসহায় অবস্থা
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৪৮ শতাংশ, যা ২০২৪ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১০.৩৪ শতাংশে।
এমন পরিস্থিতিতে মানুষের আয় বাড়েনি। বরং অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই বেকার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ লাখ ৬০ হাজারে, যা আগের বছরের তুলনায় ১ লাখ ৭০ হাজার বেশি।
অন্যদিকে, মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন।
নতুন শুল্ক-করের প্রভাব: ব্যবসায়ীর উদ্বেগ
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সম্প্রতি শতাধিক পণ্য ও সেবায় নতুন শুল্ক ও কর আরোপ করেছে।
এতে ওষুধ, সাবান, ডিটারজেন্ট, ফল, রেস্তোরাঁ সেবা এবং এমনকি ইন্টারনেটের মতো প্রয়োজনীয় খাতেও খরচ বাড়ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুল্ক বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে এবং এর ফলে পণ্যের দাম আরও বাড়তে পারে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, “এ ধরনের শুল্ক বৃদ্ধি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করবে এবং ছোট ও মাঝারি শিল্পখাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান জানিয়েছেন, “ওষুধের উৎপাদন খরচ বাড়বে এবং এর প্রভাব সরাসরি ভোক্তাদের ওপর পড়বে।”
আইএমএফের শর্ত: রাজস্ব বাড়ানোর চাপ
সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ করতে গিয়ে জনগণের ওপর করের বোঝা বাড়িয়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
কিন্তু অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “রাজস্ব ঘাটতি পূরণ করতে শুল্ক ও কর বাড়ানো ছাড়া বিকল্প ছিল না।”
এ সিদ্ধান্তে আইএমএফের শর্ত পূরণ হলেও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান আরও খারাপ হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
রাজনৈতিক সমালোচনা: গণবিরোধী নীতি
সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কঠোর সমালোচনা করেছে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি এবং সমাজতান্ত্রিক দল এই সিদ্ধান্তকে গণবিরোধী বলে আখ্যা দিয়েছে।
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম বলেন, “মূল্যস্ফীতির চাপে জর্জরিত মানুষের ওপর শুল্ক বৃদ্ধির বোঝা চাপানো অমানবিক।”
তারা টিসিবির মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ এবং রেশনিং ব্যবস্থা চালু করার দাবি জানিয়েছেন।
অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ: করনীতি পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী নয়।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “জিনিসপত্রের দাম এমনিতেই অনেক বেশি। শুল্ক বৃদ্ধির ফলে মানুষের প্রকৃত আয় আরও কমে যাবে।”
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, “এ ধরনের কর বৃদ্ধি ব্যবসায়ীদের পণ্যের দাম বাড়ানোর সুযোগ করে দেবে, যা আরও মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি করবে।”
সর্বোপরি, বর্তমান পরিস্থিতিতে করছাড় দেওয়া এবং করব্যবস্থা সহজ করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।