,

কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প: উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা থেকে বাস্তবতার কঠিন চ্যালেঞ্জ

টানেলটির আয় থেকে ব্যয়ের ফারাক ক্রমশ বাড়ছে

বাংলাদেশের প্রথম নদীর তলদেশে নির্মিত টানেল কর্ণফুলী টানেল বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধনের এক বছর পরই বড় ধরনের লোকসানের মুখোমুখি।

যে আশাবাদ নিয়ে এই প্রকল্প শুরু হয়েছিল, তা এখন আর পুরোপুরি বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

উদ্বোধনের পর থেকে যে আয়-ব্যয়ের হিসাব পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রতি দিন প্রায় চারগুণ লোকসান গুনতে হচ্ছে এই প্রকল্পে।

২০২৩ সালের ২৮শে অক্টোবর এই টানেলের উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

উদ্বোধনের পর থেকেই কর্ণফুলী টানেল লোকসান গুনতে শুরু করে।

এক বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, টানেলটি দৈনিক আয় করছে ১০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা, অথচ ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৩৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকা।

উচ্চ ব্যয়ের প্রকল্পের অপব্যবহার

বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বাস্তবায়িত উচ্চ খরচের প্রকল্পগুলোর একটি এই কর্ণফুলী টানেল।

প্রায় দশ হাজার সাতশো কোটি টাকার এ প্রকল্পকে আদৌ লাভজনক করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে।

ঋণের টাকা দিয়ে নির্মিত এই প্রকল্প থেকে আয় তো দূরের কথা, রক্ষণাবেক্ষণের খরচই ওঠানো সম্ভব হচ্ছে না।

এই পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কর্ণফুলী টানেল একটি অবাস্তব প্রকল্প ছিল, আমরা এখন এই লোকসান কমানোর উপায় খুঁজছি।”

আয় ও ব্যয়ের বিশদ পরিসংখ্যান

উদ্বোধনের পর থেকে এক বছরে কর্ণফুলী টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল করেছে ১৪ লাখ ১১ হাজার ৪১২টি।

এর মধ্যে প্রায় ৭৬ শতাংশ ছিল হালকা যানবাহন।

টানেল কর্তৃপক্ষের দেয়া হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে প্রায় চার হাজার গাড়ি টানেল ব্যবহার করছে।

তবে প্রতিদিনের খরচ বাবদ ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৩৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকা, যা দৈনিক আয়ের প্রায় চারগুণ বেশি।

এখন পর্যন্ত আয় হয়েছে মোট ৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, যা প্রতিদিনের গড় আয়ের মাত্র ৩০ শতাংশ।

যে সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছিল

২০১৭ সালে সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় আশা করা হয়েছিল, প্রতিদিন গড়ে ১৭ হাজার গাড়ি চলবে এই টানেল দিয়ে।

২০২৫ সালে এই সংখ্যা প্রায় ২৮ হাজার হবে বলেও ধারণা দেয়া হয়েছিল।

কিন্তু প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ হয় ২০২৩ সালে।

এখন দেখা যাচ্ছে, প্রতিদিন গড়ে মাত্র চার হাজার গাড়ি টানেল ব্যবহার করছে, যা সমীক্ষার অনুমানের এক-চতুর্থাংশেরও কম।

ব্যর্থতার পেছনের কারণসমূহ

এই টানেল প্রকল্পে লোকসানের অন্যতম কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন সমীক্ষার ভুল অনুমান এবং অপরিকল্পিত বাস্তবায়নকে।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামসুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এই প্রকল্পের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় রাজনীতি বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল। প্রকৃত পরিস্থিতি বিবেচনা না করেই ভুল সমীক্ষা করা হয়েছিল।”

তিনি মনে করেন, এমন প্রকল্পে ব্যয় কমানো কঠিন হবে, কারণ মাটির নিচে নির্মাণের কারণে অপারেশন খরচ অনেক বেড়ে গেছে।

টানেলের ব্যবহার কম হওয়ার কারণ

টানেলের ব্যবহার কমে যাওয়ার পেছনে বিশেষজ্ঞরা কিছু কারণ নির্দেশ করছেন।

টানেলে বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল বা সিএনজির মতো যানবাহনের প্রবেশ নিষিদ্ধ।

এছাড়া কর্ণফুলী টানেলের কাছেই অবস্থিত শাহ আমানত সেতুর টোল খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক কম।

ফলে যানবাহনগুলো সেতু ব্যবহারকেই বেশি উপযুক্ত মনে করছে।

আঞ্চলিক উন্নয়নের অভাব

কর্ণফুলী টানেলের মূল উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রাম শহরকে দক্ষিণাঞ্চলের সাথে সংযুক্ত করে “ওয়ান সিটি, টু টাউন” মডেলে রূপান্তরিত করা।

কিন্তু এই প্রান্তে এখনও তেমন কোনো শিল্প-কারখানা স্থাপিত হয়নি।

ফলে এই অঞ্চলে ট্রাফিক বাড়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কম।

প্রকল্পটি নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা

কর্ণফুলী টানেল থেকে লোকসান কমানোর জন্য সরকার এখন নানামুখী পরিকল্পনা করছে।

এতে টোল হারের সমন্বয়, এবং টানেলের ব্যবহার বাড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে।

সেতু ও যোগাযোগ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা সড়ক বিভাগের সাথে আলোচনা করে এই সংকট কাটানোর উপায় খুঁজছি।”

তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এমন উচ্চ খরচের প্রকল্পের জন্য দীর্ঘমেয়াদে দেশের ওপর অর্থনৈতিক বোঝা বাড়তে পারে।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামসুল হক মনে করেন, “কিছু প্রকল্প থাকে যেগুলোতে ভুল পরিকল্পনা করা হয়েছে, এগুলো শুধরানো কঠিন। কর্ণফুলী টানেল এমনই একটি প্রকল্প।”

ভবিষ্যৎ কি?

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কর্ণফুলী টানেল চালিয়ে রাখা ছাড়া সরকারের হাতে আর তেমন কোনো বিকল্প নেই।

কর্ণফুলী টানেলের মতো উচ্চাভিলাষী প্রকল্পে সঠিক পরিকল্পনা ও সমীক্ষার গুরুত্ব আরো একবার প্রমাণিত হয়েছে।

এই ভুলের পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হতে পারে।

সার্বিকভাবে, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের লাভজনকতার আশা কম হলেও এটিকে চালু রাখতে হবে ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতার কারণে।

অর্থাৎ, প্রকল্পের লক্ষ্য বাস্তবায়িত না হলেও, এটিকে চালিয়ে যাওয়ার দায় এখন সরকারের কাঁধে।

আরও পড়তে পারেন