ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন, দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ কেন্দ্র।
দিনরাত লাখো যাত্রীর পদভারে মুখর এই স্টেশনে লুকিয়ে আছে ভয়াবহ এক অপরাধ চক্র।
এই চক্র শিশু, কিশোরী এবং নারীদের কেনাবেচা থেকে শুরু করে বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করাসহ নানা নৃশংস কর্মকাণ্ডে জড়িত।
কমলাপুরে গড়ে ওঠা মানবপাচার চক্র
কমলাপুর রেলস্টেশনকে ঘিরে গড়ে ওঠা মানবপাচার চক্রটি ১০ থেকে ১২ জন সদস্যের।
এই চক্রের মূলহোতা রুবেল নিজেই স্বীকার করেছেন শিশু এবং কিশোরী বিক্রির সঙ্গে জড়িত থাকার কথা।
একজন ক্রেতা সেজে প্রতিবেদক রুবেলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সে দাবি করে যে, নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে যে কোনো বয়সী শিশু সরবরাহ করা সম্ভব।
রুবেল জানিয়েছে, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে তার চক্রের সদস্যরা শিশু চুরি করে এনে তাদের কাছে হস্তান্তর করে।
এই চুরি করা শিশুদের কোনো পরিবারে তুলে দেওয়া হয় অথবা বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়।
ভয়ঙ্কর সত্য: শিশু ও নারীদের কেনাবেচা
চক্রের প্রধান রুবেল দাবি করেছে, শুধু শিশু নয়, কিশোরী এবং তরুণীদেরও বিক্রি করে তারা।
রুবেল এক ক্রেতাকে ৫ মাস বয়সী একটি ছেলে শিশুর জন্য ১ লাখ টাকা দাবি করে।
অন্যদিকে, এক কিশোরী মারিয়ার জন্য ২০ হাজার টাকা চেয়ে জানায় যে মেয়েটিকে কোনো অর্থ দেওয়া লাগবে না।
এই চক্র শুধু শিশুদের নয়, ভবঘুরে কিশোরী এবং তরুণীদেরও নানা কাজে ব্যবহার করে।
এক কিশোরী প্রতিবেদককে জানায়, রুবেল তাকে বিভিন্ন অনৈতিক কাজে বাধ্য করেছে এবং ভয় দেখিয়ে তার নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।
শিকারের কাহিনি: অসহায় শিশুরা
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পারিবারিক নির্যাতন অথবা অভাবের কারণে পালিয়ে আসা শিশুরাই এই চক্রের শিকার হয়।
এক কিশোরী জানিয়েছে, সৎমায়ের অত্যাচারে বাড়ি থেকে পালিয়ে কমলাপুরে আশ্রয় নিয়েছে।
৭ বছর বয়সে পালিয়ে আসা এই কিশোরী এখন পুরোপুরি নেশায় ডুবে গেছে এবং রুবেলের চক্রের কাজ করতে বাধ্য হয়।
অন্য একজন তরুণী জানান, প্রেমের ফাঁদে পড়ে অনেক কিশোরী এখানে এসে আটকা পড়ে যায়।
কিছু ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের সঙ্গে রাগ করে আসা শিশুরাও আর ফিরে যেতে পারে না পরিবারে।
কমলাপুর: অসহায়দের আশ্রয় নাকি অপরাধের কেন্দ্র
কমলাপুর রেলস্টেশনে বসবাসকারী অনেকে নিজেদের বাড়িঘর এবং পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছে।
এক তরুণ জানান, তার জন্ম কমলাপুর রেলস্টেশনে এবং এখানেই তার জীবনযাপন।
তার মতে, স্টেশনে যাঁরা থাকে, তাঁদের কেউ ভালো, কেউ খারাপ।
তবে সবাই কোনো না কোনোভাবে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হতে বাধ্য হয়।
এই তরুণের ভাষায়, কমলাপুর তার জন্য ভালোবাসার জায়গা হলেও এখানে অপরাধের চক্রে জড়িয়ে পড়া যেন এক বাস্তবতা।
অপরাধ চক্রের প্রতিদিনের কাজ
স্টেশনে অবস্থান করে দেখা গেছে, যাত্রীদের ব্যাগ এবং মোবাইল ছিনতাই থেকে শুরু করে নানা অপরাধ নিয়মিত ঘটে।
এক কিশোরী জানায়, অনেক সময় যাত্রীদের কাছ থেকে চুরি করা জিনিস বিক্রি করেও আয় করে তারা।
নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনের অভ্যাস এদের মধ্যে সাধারণ বিষয়।
অপরাধচক্রের সদস্যরা নিয়মিতভাবে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শিশু এনে বিক্রি করে আবার নিজেদের এলাকায় নতুন শিকার খুঁজতে যায়।
এই ভয়াবহ চক্র সম্পর্কে স্থানীয় প্রশাসনের সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি।