,

একাদশ নির্বাচনের ভোট কারচুপির মূল কারিগররা অধরা

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশে ব্যাপক ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠেছিল। রাতে ব্যালট ভর্তি থেকে শুরু করে প্রশাসনের নেপথ্য ভূমিকা, সব কিছুই আজও বিতর্কিত। তবে জড়িত সরকারি কর্মকর্তারা এখনও কোনও শাস্তির মুখোমুখি হননি। প্রশাসনের মূল ব্যক্তিদের ভূমিকা এবং বর্তমান অবস্থান নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ উঠে এসেছে।

বরিশালসহ বিভিন্ন জেলায় অস্বাভাবিক ভোটের ফলাফল

বরিশাল-১ আসনে ২০১৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বিপুল ব্যবধানে জয়ী হন। ২ লাখ ৫ হাজার ৫০২ ভোট পাওয়া এই প্রার্থীর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির জহিরউদ্দিন স্বপন পান মাত্র ১ হাজার ৩০৫ ভোট।

এই ফলাফলকে অবিশ্বাস্য উল্লেখ করে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে। বরিশালসহ দেশের পাঁচটি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বৈধ ভোটের ৯৩ থেকে ৯৯ শতাংশ পান। তবে ভোটের এমন ফলাফলকে ‘জালিয়াতি ছাড়া সম্ভব নয়’ বলে অভিহিত করেছেন বিশ্লেষকরা।

রিটার্নিং কর্মকর্তারা যেভাবে এই কারচুপির মূল দায়িত্বে ছিলেন, তাদের কেউই আজও কোনও জবাবদিহিতার সম্মুখীন হননি। বরং অনেকে পদোন্নতি পেয়েছেন।

রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নেপথ্য ভূমিকা

একাদশ নির্বাচনে ৬৪ জেলায় রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন জেলা প্রশাসকরা। ঢাকা ও চট্টগ্রামে দায়িত্বে ছিলেন বিভাগীয় কমিশনাররা।

বরিশালের রিটার্নিং কর্মকর্তা আজিয়র রহমান সেই সময় জেলা প্রশাসক ছিলেন। তিনি পদোন্নতি পেয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডে যান। তবে সম্প্রতি ক্ষমতা বদলের পর তাকে রাবার বোর্ডে বদলি করা হয়েছে।

নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একাংশ নির্বাচনে অনিয়মের কথা স্বীকার করেছেন। তবে তারা বলছেন, পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চাপে তাদের অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।

এদিকে, রাতের ভোট কারচুপির ঘটনায় মূল দোষীদের শাস্তি দাবি করেছেন বিএনপির জহিরউদ্দিন স্বপন। তিনি বলেন, “রিটার্নিং কর্মকর্তারা রাতের ভোটের বাস্তবায়নকারী ছিলেন। তাদের শাস্তি দিতে হবে।”

প্রশাসনিক জালিয়াতি ও নির্বাচনী অর্থ লেনদেন

সরকারি কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক আনুগত্য যাচাই করে নির্বাচনী দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। অনেক কর্মকর্তাকে মোটা অঙ্কের টাকাও দেওয়া হয়।

একজন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভোটের আগের রাতে তার কেন্দ্র থেকে ৩ হাজার ব্যালট পুলিশ নিয়ে যায় এবং বাক্সে ভরে রাখে। পরদিন সকালে কেন্দ্র থেকে ভোটারদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়।

ময়মনসিংহের একজন প্রার্থী জানিয়েছেন, এসপি থেকে শুরু করে ওসি পর্যন্ত নির্বাচনী জালিয়াতিতে জড়িত ছিলেন। তাদের বিপুল অঙ্কের টাকা দেওয়া হয়েছিল।

একই সঙ্গে, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই-এর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২২টি আসন ছাড়া বিএনপির জয় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকায় ভোটের ফল পাল্টে দেওয়া হয়।

নির্বাচন কমিশন ও সেনাবাহিনীর ভূমিকা

নির্বাচন কমিশন সেই সময়ে সমস্ত অভিযোগ উপেক্ষা করে ফলাফল প্রকাশে এগিয়ে যায়। তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেন, তিনি নির্বাচনে সন্তুষ্ট।

অথচ বিএনপি লিখিতভাবে জানায়, ২২৯ আসনে আগের রাতে ভোট সম্পন্ন হয়েছে। বিএনপির প্রার্থীরা অভিযোগ করেন, তাদের প্রচারে বাধা দেওয়া হয় এবং অনেককে নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ দেওয়া হয়নি।

সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। একাধিক কেন্দ্রের বাইরে সেনাসদস্যদের উপস্থিতি থাকলেও তারা কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখেনি।

জড়িত কর্মকর্তারা কোথায়

নির্বাচনে জালিয়াতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত কর্মকর্তাদের অনেকে এখনও সরকারি পদে বহাল আছেন।

তন্ময় দাস, আবুল ফজল মীর, নাজিয়া শিরিনসহ বেশ কয়েকজন রিটার্নিং কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন। তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর কিছু কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের রিটার্নিং কর্মকর্তা এ জেড এম নুরুল হক ব্যতিক্রম ছিলেন। তার তত্ত্বাবধানে বিএনপি জয়ী হয়। তিনি নিজেকে এ অনিয়ম থেকে দূরে রাখতে পেরেছিলেন।

নির্বাচনে যুক্ত কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়ে এখনও তদন্ত চলছে। তবে শাস্তি কিংবা জবাবদিহিতার কোনও দৃষ্টান্ত এখনো তৈরি হয়নি।

আরও পড়তে পারেন