২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার প্রায় ১০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সেই সময় এডিপির আকার ছিল ২৮ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকায়।
গত ১৫ বছরে এডিপির আওতায় খরচ হয়েছে প্রায় ৭ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা।
শ্বেতপত্র কমিটির গবেষণায় উঠে এসেছে, এর ৪০ শতাংশ অর্থ লুটপাট বা বিদেশে পাচার হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মেগা প্রকল্পগুলো লোক দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতি এবং আত্মসাতের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে রাজনৈতিক সুবিধাভোগী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে লুটপাটের প্রবণতা ছিল তীব্র।
লুটপাটের শিকার মেগা প্রকল্প
মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা।
কাজ শেষ করতে ১০ বছর সময় লাগায় এর ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপন প্রকল্পের ব্যয় ৯১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রাথমিকভাবে ৩৭৮ কোটি টাকার এই প্রকল্পের ব্যয় এখন ৭২৩ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের খরচ তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০১০ সালে ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকার প্রকল্পটি বর্তমানে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকায় বাস্তবায়ন হচ্ছে।
ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পেও লুটপাট
ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত প্রকল্পগুলোর মধ্যে মেট্রোরেল এবং পদ্মা সেতু সম্পন্ন হয়েছে।
তবে রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বাকি প্রকল্পগুলোর ব্যয় দফায় দফায় বৃদ্ধি পেয়ে ৩ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
এসব প্রকল্পের ২ লাখ ৮ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ এবং বাকি ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় করা হয়েছে।
শুরু থেকে জুলাই ২০২৪ পর্যন্ত এ প্রকল্পগুলোর গড় আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৭৮ দশমিক ৮২ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রকল্পগুলোর বেশিরভাগই অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া অনুমোদিত হয়েছে।
তবে প্রকৃত উন্নয়ন না করে লোক দেখানোর জন্যই এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।
পাচারের পরিমাণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বোঝা
শ্বেতপত্রের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে।
বর্তমান বাজার দরে এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকার সমান।
এই হিসাবে প্রতি বছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অর্থপাচারের বোঝা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বহন করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পগুলো রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে।
অনেক প্রকল্পের সময়সীমা এবং ব্যয় বারবার বৃদ্ধি করে লুটপাটের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে।
অনিয়মিত প্রকল্প এবং আর্থিক অপচয়
২০১০ সালে গাজীপুর-আজমতপুর সড়ক প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৯৫ কোটি টাকা।
১৭ বছর পর এর ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২১৪ কোটি টাকায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রকল্পগুলো কোনো অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই নেওয়া হয়েছে।
লোক দেখানোর প্রকল্পের আড়ালে রাজনৈতিক সুবিধাভোগীদের কাছে সম্পদ স্থানান্তরিত হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন হার অত্যন্ত ধীর।
এর ফলে দেশের আর্থিক অগ্রগতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে।
ভবিষ্যৎ উন্নয়নের পথে বড় বাধা
শেখ হাসিনা সরকারের আমলে মেগা প্রকল্পগুলোর আড়ালে দেশজুড়ে দুর্নীতির সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অপচয় এবং লুটপাট দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের পথে বড় বাধা হিসেবে কাজ করবে।
এমনকি প্রকল্পগুলোতে আকাশচুম্বী ব্যয় বাড়ানোর কারণে জাতীয় ঋণের বোঝা বেড়েছে।
ফলে দেশের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।