বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক, এস আলম গ্রুপের শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে ১০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করেছে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক যে শেয়ারগুলো জব্দ করেছিল, সেগুলো এখন বিক্রি করা হবে।
এছাড়া নতুন শেয়ার ইস্যু এবং বিদেশি বিনিয়োগ পুনরুদ্ধার করে ব্যাংকের আর্থিক ঘাটতি মেটানোর কৌশল হাতে নিয়েছে নতুন পরিচালনা পর্ষদ।
পুনরুদ্ধার কৌশলের কেন্দ্রে এস আলম গ্রুপ
ইসলামী ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এস আলম গ্রুপের শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে ব্যাংকটি ১০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করবে।
এস আলম গ্রুপের শেয়ারের মূল্য বর্তমানে ১,৬০০ কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন তিনি।
ব্যাংকের আর্থিক ঘাটতি ২০ হাজার কোটি টাকা, যা এস আলমের শেয়ার বিক্রি ও নতুন শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে পূরণ করা হবে।
২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটির মোট ঋণের ৮০ শতাংশ দখল করে নেয়।
নতুন পরিচালনা পর্ষদের পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, এস আলম গ্রুপ ৮০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছিল।
এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
বিদেশি বিনিয়োগ পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ
ইসলামী ব্যাংক তাদের আগের বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পুনরায় বিনিয়োগে আগ্রহী করার উদ্যোগ নিয়েছে।
সৌদি আরবের আল-রাজি কোম্পানি এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক কর্পোরেশন (আইএফসি) এর সঙ্গে আলোচনা চলছে।
আগামী জানুয়ারির মধ্যে এই সংস্থাগুলোকে পুনরায় বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার পরিকল্পনার কথা জানান চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ।
২০১৭ সালের পর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ধীরে ধীরে ইসলামী ব্যাংক থেকে সরে যায়।
২০২৩ সালে বিদেশি শেয়ারধারীরা ব্যাংকটি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বিদেশি মালিকানার হার ৮.২৬ শতাংশে নেমে আসে, যা আগে ৭০ শতাংশ ছিল।
নতুন বোর্ড ও ইতিবাচক পরিবর্তন
বাংলাদেশ ব্যাংক আগস্টে ইসলামী ব্যাংকের নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে।
নতুন বোর্ড গঠনের পর তিন মাসে ব্যাংকটি ৪,৯৭২ কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করেছে।
এই সময়ে ব্যাংকটি ২০,৪১৮ কোটি টাকার বৈদেশিক পরিশোধ এবং ১০,১০৩ কোটি টাকার রেমিট্যান্স সংগ্রহ করেছে।
এছাড়া ব্যাংকের এজেন্ট আউটলেটগুলোতে আমানত সংগ্রহে তিনজন কর্মী নিয়োগ করা হয়েছে।
মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রদানকারী বিকাশের সাথে একটি চুক্তি করে আমানত সংগ্রহের নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করেছে ব্যাংকটি।
এস আলম গ্রুপ ও ইসলামী ব্যাংকের সংকটের ইতিহাস
২০১৭ সালে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
ডিজিএফআই-এর সহযোগিতায় এই নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর এস আলম গ্রুপের কারণে ব্যাংকের বিদেশি বিনিয়োগ ও লাভের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।
২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে ইসলামী ব্যাংক ৮৯ কোটি টাকার লোকসান করে, যা গত কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবার।
এস আলম গ্রুপের কারণে সৃষ্ট ঋণের বিপরীতে উচ্চতর প্রভিশন বজায় রাখতে গিয়ে এই লোকসান হয়।
ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ ১৭,৭৫১ কোটি টাকায় পৌঁছায়, যা তিন মাস আগে ৮,৮৫০ কোটি টাকা ছিল।
ব্যাংক পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, ইসলামী ব্যাংককে পুনরুদ্ধার করা দেশের ব্যাংকিং খাতের বড় সংকট সমাধানে সহায়ক হবে।
তিনি বলেন, “এস আলম গ্রুপ ও বেক্সিমকোর মতো কোম্পানিকে জাতীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও তাদের ব্যক্তিগত অপরাধের জন্য ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
বিশ্লেষকদের মতে, ইসলামী ব্যাংকের পুনরুদ্ধার একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া।
নতুন পরিচালনা পর্ষদের পরিকল্পিত পদক্ষেপ ব্যাংকটির ভবিষ্যৎকে স্থিতিশীল করতে পারে বলে আশা করছেন তারা।
এস আলম গ্রুপের শেয়ার বিক্রি এবং বিদেশি বিনিয়োগ পুনরুদ্ধার ইসলামী ব্যাংকের জন্য নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলতে পারে।