,

ইসরায়েল-হেজবুল্লাহ সংঘাত: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যুদ্ধবিরতির আহ্বান কতটা বাস্তবসম্মত?

বর্তমানে ইসরায়েল এবং হেজবুল্লাহর মধ্যে চলমান সংঘাত আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আরও দশটি দেশ যৌথভাবে অবিলম্বে একটি যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে হোয়াইট হাউস এই প্রস্তাবের গতি বাড়ানোর চেষ্টা করছে, যা বাইডেন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ‘যুগান্তকারী’ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এই যুদ্ধবিরতির আহ্বান, বাস্তবিক অর্থে, কতটা কার্যকর হতে পারে?

যুদ্ধবিরতির আহ্বানের প্রেক্ষাপট

গভীর রাতে আয়োজিত এক জুম ব্রিফিংয়ে মার্কিন প্রশাসনের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে অবহিত করেন। ব্রিফিংয়ের আকস্মিকতা এবং সাংবাদিকদের ব্যাপক উপস্থিতি ইঙ্গিত দেয়, আন্তর্জাতিকভাবে এই সংঘাতের দ্রুত সমাধানের প্রয়োজনীয়তা কতটা জরুরি হয়ে উঠেছে। প্রশাসনের বক্তব্য অনুসারে, যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে ২১ দিনের জন্য লড়াই বন্ধ রাখতে হবে, যাতে মধ্যস্থতার আলোচনার জন্য একটা ‘স্থান’ তৈরি হয়। এই প্রস্তাব জাতিসংঘের সুরক্ষা কাউন্সিলের রেজ্যুলেশন ১৭০১-এর ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের দিকেও নির্দেশ করে, যা ২০০৬ সালের ইসরায়েল-লেবানন যুদ্ধের অবসান ঘটাতে গৃহীত হয়েছিল।

কিন্তু এই প্রস্তাব যুদ্ধের মাঠে কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। বিশেষ করে যখন ইসরায়েল এবং হেজবুল্লাহ দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থানে অনড় রয়েছে এবং তাদের সামরিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। লেবাননের রাজধানী বৈরুত এবং অন্য কিছু এলাকায় ইসরায়েলি বিমান হামলা এবং হেজবুল্লাহর রকেট হামলার খবর গভীর রাতের ব্রিফিংয়ের পরপরই কূটনীতিকদের কাছে পৌঁছায়।

ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতিতে এখনও পর্যন্ত সম্মতি দেননি। বরং তিনি ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীকে ‘পূর্ণ শক্তি’ দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে স্পষ্ট জানানো হয়েছে যে, ইসরায়েল যুদ্ধের এই মুহূর্তে কোনও ধরনের যুদ্ধবিরতিতে যেতে আগ্রহী নয়। তাদের মূল লক্ষ্য হল হেজবুল্লাহর রকেট হামলা বন্ধ করা এবং তাদের আক্রমণের মাধ্যমে উত্তরাঞ্চল থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষদের ফিরিয়ে আনা।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বর্তমানে লেবাননের বেশ কিছু অঞ্চলে আক্রমণ চালাচ্ছে, যেখানে হেজবুল্লাহর অবস্থান এবং সামরিক ঘাঁটি রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই অঞ্চলে ইসরায়েলের হামলা কেবল হেজবুল্লাহর বিরুদ্ধে নয়, বরং লেবাননের গোটা অবকাঠামোর উপরেও মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি বিমান হামলায় লেবাননে এখন পর্যন্ত ৬০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ৫০ জন শিশু।

হেজবুল্লাহর প্রতিক্রিয়া

অন্যদিকে, হেজবুল্লাহও যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার কোনও ইঙ্গিত দেয়নি। তাদের মূল লক্ষ্য হলো ইসরায়েলি হামলা থেকে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলকে রক্ষা করা এবং নিজেদের শিয়া সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব বজায় রাখা। হেজবুল্লাহ লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখতে চায়, যেখানে তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব অত্যন্ত শক্তিশালী।

তাছাড়া, লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতিও প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষরের খবর প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং একে ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি মনে করেন, এই মুহূর্তে হেজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলের কোনও সমঝোতা সম্ভব নয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা

বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা ইসরায়েল এবং লেবাননের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করেছে বলে দাবি করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত আমোস হোচস্টেইন দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। তাদের পরিকল্পনা হলো ২১ দিনের যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে আলোচনা শুরু করা এবং দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়া। তবে এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্য উভয় পক্ষের রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন, যা বর্তমানে দেখা যাচ্ছে না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের আশা ইসরায়েল এবং লেবানন সরকার এই প্রস্তাব মেনে নেবে এবং যুদ্ধবিরতি কার্যকর করবে। তবে এই মুহূর্তে উভয় পক্ষের মধ্যেই যুদ্ধের আগ্রাসী মনোভাব অব্যাহত রয়েছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলছে।

রেজ্যুলেশন ১৭০১ এবং দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের প্রস্তাব

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা ইসরায়েল-হেজবুল্লাহর মধ্যে সংঘাতের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য জাতিসংঘের সুরক্ষা কাউন্সিলের রেজ্যুলেশন ১৭০১ বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছে। এই রেজ্যুলেশনের মাধ্যমে হেজবুল্লাহকে লিতানি নদীর দক্ষিণ থেকে পশ্চাদপসরণ করতে হবে এবং তাদের নিরস্ত্রীকরণ করতে হবে। যদিও ২০০৬ সাল থেকে দুই পক্ষই এই রেজ্যুলেশন ভঙ্গের অভিযোগ করে আসছে, তবুও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আশা করছে যে এই যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে তারা একটি দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রক্রিয়ার দিকে অগ্রসর হতে পারবে।

যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা যদিও যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে, তবে ইসরায়েল এবং হেজবুল্লাহর বর্তমান অবস্থান এই পরিকল্পনাকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। বিশেষ করে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং হেজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরাল্লাহর যুদ্ধবিরতির বিষয়ে কোনও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

এই মুহূর্তে লেবাননের ভঙ্গুর অবস্থা এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তা উদ্বেগকে সামনে রেখে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনার সম্ভাবনা ক্ষীণ। হেজবুল্লাহর আক্রমণ এবং ইসরায়েলের পাল্টা জবাবের মাধ্যমে সংঘাত আরও ঘনীভূত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে একটি কার্যকর যুদ্ধবিরতির জন্য দুই পক্ষের মধ্যেই চরম রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন, যা বর্তমানে অনুপস্থিত।

যুদ্ধের ময়দানে দুই পক্ষের অবস্থান কঠোর হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং আক্রমণের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইসরায়েল-হেজবুল্লাহ সংঘাতের ইতিহাস বলে, এই ধরনের সংঘাতের দ্রুত সমাধান সাধারণত পাওয়া যায় না। যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ দিচ্ছে, তবে বাস্তবিক অর্থে এই সংঘাতের একটি দীর্ঘমেয়াদি শান্তিপূর্ণ সমাধান পাওয়া এই মুহূর্তে অত্যন্ত কঠিন।

সম্পাদকীয় বিশ্লেষণ: যুদ্ধবিরতি আহ্বান, কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে কতটা মিল?

ইসরায়েল এবং হেজবুল্লাহর চলমান সংঘাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যুদ্ধবিরতির আহ্বান নিঃসন্দেহে একটি সময়োপযোগী এবং মানবিক উদ্যোগ। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, এই যুদ্ধবিরতি কতটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে? ইসরায়েল এবং হেজবুল্লাহ উভয় পক্ষই তাদের অবস্থান থেকে সরে আসার কোনও ইঙ্গিত দেয়নি। ইসরায়েল কৌশলগতভাবে লেবাননের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, অন্যদিকে হেজবুল্লাহ নিজেদের সামরিক শক্তি এবং রাজনৈতিক প্রভাব ধরে রাখতে চায়।

এই পরিস্থিতিতে, ২১ দিনের সাময়িক যুদ্ধবিরতির আহ্বান হয়তো আন্তর্জাতিক কূটনীতির একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য হতে পারে, কিন্তু এর মাধ্যমে স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। উভয় পক্ষের মধ্যে আস্থার সংকট, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং বহুমাত্রিক সামরিক সংঘাতের প্রেক্ষাপটে, একটি কার্যকর এবং দীর্ঘমেয়াদি সমঝোতা অর্জন করা অত্যন্ত কঠিন।

এটি স্পষ্ট যে, আন্তর্জাতিক চাপ এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টা যতই জোরদার হোক না কেন, স্থায়ী সমাধান অর্জনের জন্য ইসরায়েল এবং হেজবুল্লাহকে নিজেদের স্বার্থের বাইরে গিয়ে আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। অন্যথায়, এই যুদ্ধবিরতির আহ্বান কেবল এক সাময়িক বিরতি হিসেবেই থেকে যাবে, যা সংঘাতের গভীর সমস্যাগুলোর সমাধান করতে ব্যর্থ হবে।

আরও পড়তে পারেন