বিগত এক বছরে ইসরায়েল ও হেজবোল্লাহর মধ্যে সংঘাতের মাত্রা তীব্রতর হয়েছে। গাজা যুদ্ধের শুরু থেকেই লেবাননের সীমান্তে দুই পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময় হচ্ছে। সম্প্রতি, আল জাজিরার সাংবাদিক জেইনা খোদর বেইরুত থেকে খবর দিয়েছেন যে, এই সংঘাত এখন একটি যুদ্ধের পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।
হেজবোল্লাহ তাদের নেতা হাসান নাসরাল্লাহর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে, ইসরায়েলি বিমান হামলায় বেইরুতের আবাসিক ভবনে হামলা চালানো হয়। ইসরায়েল দাবি করেছে, এই ভবনগুলো হেজবোল্লাহর সদর দফতরের উপরে ছিল। এই হামলায় হেজবোল্লাহর দক্ষিণ সীমান্তের কমান্ডার আলী কার্কি এবং অন্যান্য উচ্চ পদস্থ কমান্ডারও নিহত হয়েছেন।
শনিবার, ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, যুদ্ধবিমানগুলো বেকা উপত্যকা ও দক্ষিণ লেবানের বিভিন্ন স্থানে হেজবোল্লাহর “শতাধিক” লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। হামলাগুলি অব্যাহত রয়েছে।
সংঘাতটি ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ওইদিন, লেবাননে ২,৮০০ জন আহত হয় যখন তাদের হাতে থাকা পেজার যন্ত্রগুলো বিস্ফোরিত হয়। এই হামলায় অন্তত নয়জন নিহত হয়, যাদের মধ্যে তিনজন শিশু ছিল।
হেজবোল্লাহ বলছে, ইসরায়েল এই হামলার জন্য দায়ী। তারা দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ লেবাননের সীমান্তে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাচ্ছে। গত বছরের ৮ অক্টোবর থেকে তারা গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধকে প্রতিহত করতে এই আক্রমণ শুরু করেছে, যা কমপক্ষে ৪১,৫০০ মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে।
ইসরায়েল প্রতিশোধমূলক হামলা চালাচ্ছে, যা এই অঞ্চলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘাতের নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
এই সংঘাত নতুন নয়। এর পেছনে প্রায় অর্ধশতকের ইতিহাস রয়েছে। চলুন এক নজরে দেখে নেওয়া যাক এই সংঘাতের মূল কাহিনী।
১৯৮২ – ইসরায়েলের আক্রমণ
জুন ১৯৮২, ইসরায়েল লেবাননে আক্রমণ শুরু করে। এই আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল প্যালেস্টাইন মুক্তি সংস্থা (PLO) কে দমন করা। লেবাননের গৃহযুদ্ধ তখন চলছে।
ইসরায়েল দক্ষিণ লেবাননে প্রবেশ করে এবং পশ্চিম বেইরুত পর্যন্ত পৌঁছায়। সেখানে PLO এর উপর আক্রমণ চালানো হয়। পিএলও তিউনিসিয়ায় চলে যায়, কিন্তু ইসরায়েলের সেনাবাহিনী লেবাননে থেকে যায়।
১৯৮৩ – হামলা শুরু
১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে বিদেশি সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ চালানো হয়। ২৩ অক্টোবর, ১৯৮৩ তারিখে বেইরুতের একটি ব্যারাকের উপর হামলা চালানো হয়, যেখানে ৩০০ এরও বেশি ফরাসি ও আমেরিকান শান্তিরক্ষক নিহত হয়।
১৯৮৫ – হেজবোল্লাহর উত্থান
১৯৮৫ সালে হেজবোল্লাহ এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, তারা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে লিটানি নদীর কাছে প্রস্থান করতে বাধ্য করে।
ইসরায়েল একটি “নিরাপত্তা অঞ্চল” ঘোষণা করে। এই অঞ্চলের সুরক্ষার দায়িত্ব ছিল খ্রিষ্টান নেতৃত্বাধীন দক্ষিণ লেবানন সেনাবাহিনীর (SLA)।
১৯৯২ – রাজনীতিতে প্রবেশ
১৯৯২ সালে, লেবাননের গৃহযুদ্ধ শেষে হেজবোল্লাহ সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করে। তাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় এবং তারা লেবাননের ১২৮ আসনের সংসদে আটটি আসন লাভ করে।
২০০৬ – জুলাই যুদ্ধ
২০০৬ সালে হেজবোল্লাহ দুই ইসরায়েলি সেনাকে বন্দি করে এবং তাদের মুক্তির জন্য দাবি তোলে। পরে, এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে ৩৪ দিনের যুদ্ধ শুরু হয়।
এই সংঘাতে প্রায় ১,২০০ লেবানিজ এবং ১৫৮ ইসরায়েলি নিহত হয়।
২০২৩-২৪ – গাজায় পরিস্থিতি
অক্টোবর ২০২৩ সালে, হেজবোল্লাহ গাজা সমর্থনে ইসরায়েলে রকেট হামলা শুরু করে। যুদ্ধ চলাকালীন, ৯৭,০০০ মানুষ লেবানন ছেড়ে পালিয়ে যায়।
এরপর থেকে, ইসরায়েল লেবাননে হামলা চালিয়ে আসছে। এখন পর্যন্ত ৫৬৬ জন নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে ১৩৩ জন ছিল বেসামরিক নাগরিক।
সেপ্টেম্বর ২০২৪ – পেজার হামলা
সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৪ তারিখে, হেজবোল্লাহের সদস্যদের হাতে থাকা হাজার হাজার পেজার বিস্ফোরিত হয়। এই হামলায় অন্তত ১১ জন নিহত এবং ২,৭৫০ জন আহত হয়।
হেজবোল্লাহ বলেছে, তারা ইসরায়েলকে এই হামলার জন্য দায়ী করে এবং প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এই সংঘাতের ইতিহাস দেখায় যে, ইসরায়েল ও হেজবোল্লাহর মধ্যে বিবাদ দীর্ঘ এবং জটিল। বর্তমানে, এই সংঘাতের ফলে অঞ্চলটির স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়েছে।
সবার নজর এখন এই সংঘাতের পরিণতির দিকে। আসন্ন দিনগুলোতে পরিস্থিতি কোন দিকে এগোবে, তা দেখার জন্য সবাই আগ্রহী।