যুদ্ধ
,

ইসরায়েলের হামলায় হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ নিহত: ভবিষ্যতে কী হতে পারে?

ইসরায়েলের বায়ু হামলায় লেবাননের রাজধানী বেইরুতে হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরাল্লাহ নিহত হয়েছেন। শুক্রবার সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া এই আক্রমণটি ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর দাবি অনুযায়ী একটি বড় বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইরানের সাথে ইসরায়েলের সংঘাত আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

হামলায় হিজবুল্লাহর দক্ষিণ ফ্রন্টের কমান্ডার আলি কার্কি এবং আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ কমান্ডারও নিহত হয়েছেন। ইসরায়েল দাবি করেছে, বেইরুতের দক্ষিণ উপশহর দাহিয়েহতে এই ব্যাপক আক্রমণটি তাদের লক্ষ্যবস্তুতে সফলভাবে আঘাত করেছে।

হিজবুল্লাহর শক্তি: নাসরাল্লাহর যুগ

হিজবুল্লাহর নেতৃত্বে হাসান নাসরাল্লাহর সময়কাল ছিল ৩২ বছর। ১৯৯২ সালে ইসরায়েলের হামলায় তার পূর্বসূরি আব্বাস আল-মুসাভি নিহত হলে নাসরাল্লাহ হিজবুল্লাহর তৃতীয় সেক্রেটারি-জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব নেন।

হিজবুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮২ সালে, ইসরায়েলের দক্ষিণ লেবানন দখলবিরোধী লড়াইয়ে অংশ নিতে। এটি শিয়া মুসলিমদের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন পায়, এবং ইরানের সমর্থনে দক্ষিণ লেবাননে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে।

নাসরাল্লাহর জনপ্রিয়তা শিখরে পৌঁছে ২০০৬ সালের ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধের পর। তার ভাষণগুলোতে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উপাদানের সংমিশ্রণ তাকে শুধু লেবাননেই নয়, গোটা অঞ্চলেও প্রভাবশালী নেতা হিসেবে পরিচিত করে তোলে।

তবে তার সমালোচকরাও রয়েছে। তারা মনে করে, নাসরাল্লাহ ইরানের স্বার্থে কাজ করেছেন, বিশেষ করে ২০১১ সালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে দমাতে হিজবুল্লাহ যোদ্ধা পাঠানোর পর থেকে।

হামলার বিশদ

শুক্রবারের এই হামলাটি বেইরুতের দাহিয়েহ এলাকায় সংঘটিত হয়। ইসরায়েল দাবি করেছে যে, তারা হিজবুল্লাহর সদর দফতরে আঘাত করেছে এবং নাসরাল্লাহকে হত্যা করেছে। কয়েক ঘণ্টার জল্পনার পর হিজবুল্লাহ নাসরাল্লাহর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

লেবাননের জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হামলায় অন্তত ১১ জন নিহত হয়েছে এবং ১০৮ জন আহত হয়েছে। ইসরায়েলি মিডিয়া জানিয়েছে, এই আক্রমণে প্রায় ৮৫টি “বাঙ্কার-বস্টার” বোমা ব্যবহার করা হয়েছে। এসব বোমা গভীরভাবে মাটির নিচে প্রবেশ করে বিস্ফোরিত হয়।

তবে এই ধরনের বোমার ব্যবহার জেনেভা কনভেনশনের অধীনে জনবহুল এলাকায় নিষিদ্ধ। দাহিয়েহ একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা এবং এই আক্রমণে একাধিক আবাসিক ভবন ধ্বংস হয়েছে।

নাসরাল্লাহের উত্তরসূরি কে হবেন?

নাসরাল্লাহর মৃত্যুতে হিজবুল্লাহ নেতৃত্বে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। দলটির ৭ থেকে ৮ জন সদস্যের শুরা কাউন্সিল এখন নতুন নেতা বেছে নিতে বৈঠকে বসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

হিজবুল্লাহর নতুন সেক্রেটারি-জেনারেল হিসেবে আলোচিত নামগুলোর মধ্যে রয়েছে হাসান সাফিয়েদ্দিন, যিনি হিজবুল্লাহর নির্বাহী পরিষদের প্রধান। সাফিয়েদ্দিন হিজবুল্লাহর রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন এবং একইসাথে তিনি জিহাদ কাউন্সিলের সদস্য, যা দলের সামরিক কার্যক্রম তদারকি করে। সাফিয়েদ্দিন নাসরাল্লাহর মামাতো ভাই।

হিজবুল্লাহর প্রতিক্রিয়া

হিজবুল্লাহ একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে যে, নাসরাল্লাহর মৃত্যুর পরও তারা গাজা এবং লেবাননের প্রতিরক্ষায় তাদের সামরিক কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। বিবৃতির পরপরই, তারা ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে পাঁচটি রকেট হামলা চালায়।

হিজবুল্লাহ কি দুর্বল হয়েছে?

নাসরাল্লাহের মৃত্যুতে হিজবুল্লাহ সাময়িকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদে এটি হিজবুল্লাহর উপর তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে না।

হিজবুল্লাহর সামরিক শক্তি এবং বিপুল অস্ত্রাগার বজায় রয়েছে। তাছাড়া, দলের নেতৃত্বে একজন নেতা গেলে অন্যজন তাকে প্রতিস্থাপন করবে।

বৈরুতকে হিজবুল্লাহর “দুর্বলতম স্থান” হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কারণ সেখানে পশ্চিমা দূতাবাস এবং পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিরা রয়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে, হিজবুল্লাহকে সামরিকভাবে পরাজিত করার ক্ষমতা ইসরায়েলের নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা।

ইসরায়েলের জন্য কি এটি বিজয়?

ইসরায়েল এই হামলাকে একটি বড় বিজয় হিসেবে দেখছে। শুক্রবার, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা করেন, “আমরা জিতছি।”

বিশ্লেষকরা বলছেন, নাসরাল্লাহর মৃত্যুর পর ইসরায়েল এই মুহূর্তের সুযোগ নিতে চায় এবং হিজবুল্লাহর নেতৃত্বে শূন্যতার সুযোগে আক্রমণ চালিয়ে যাবে।

তবে, ইসরায়েল সম্ভবত তাদের নির্ধারিত লক্ষ্যে পুরোপুরি সফল হতে পারবে না। অতীতে সংঘাত বাড়ানোর পর ইসরায়েল প্রায়শই আরও প্রতিরোধ এবং বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে।

ইরানের প্রতিক্রিয়া কী হবে?

নাসরাল্লাহর মৃত্যুর পর ইরানের প্রতিক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান সম্ভবত এখনই পুরোপুরি সংঘাতে জড়াতে চাইবে না। তারা তাদের প্রচলিত নীতি অনুসরণ করে মিত্র গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে লড়াই চালিয়ে যেতে পারে, যেমন ইরাক ও ইয়েমেনে।

ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান একটি বিবৃতিতে বলেছেন, নাসরাল্লাহর মৃত্যু প্রতিরোধ আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করবে। তিনি আরও বলেন, এই হামলার নির্দেশ নিউইয়র্ক থেকে দেওয়া হয়েছে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর উপস্থিতির কথা উল্লেখ করে।

যুক্তরাষ্ট্র এই হামলার জন্য সম্পূর্ণ দায় এড়াতে পারে না, কারণ তারা ইসরায়েলকে অস্ত্র এবং সামরিক সহায়তা প্রদান করেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

আরও পড়তে পারেন