সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন নিয়ে রাজনীতিতে দ্বিধা, ভোটের সমীকরণে আসছে পরিবর্তন?
বাংলাদেশে আগামী সংসদ নির্বাচন কবে হবে তা নিশ্চিত নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আওতায় নির্বাচন হবে বলে গুঞ্জন থাকলেও, এখনো দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়নি। এর মধ্যেই রাজনৈতিক অঙ্গনে উঠেছে একটি নতুন প্রশ্ন – নির্বাচনী পদ্ধতি পরিবর্তন করা উচিত কিনা। আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থার প্রস্তাবটি নানা ছোট-বড় রাজনৈতিক দল থেকে এসেছে, যা এই মুহূর্তে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, সিপিবি, গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ একাধিক রাজনৈতিক দল এই পরিবর্তনের পক্ষে মত দিয়েছে। তবে বিএনপি এবং তাদের সমমনা অনেক দলই এর বিরোধিতা করছে।
এমন পদ্ধতি চালু হলে, কোন দল লাভবান হবে আর কোন দল পিছিয়ে পড়বে – এই নিয়ে রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও চলছে নানা আলোচনা। বর্তমান ব্যবস্থায় এককভাবে জয়লাভের সম্ভাবনা রাখে বড় দলগুলো। কিন্তু আনুপাতিক ব্যবস্থায় ভোটের শতাংশের ভিত্তিতে সংসদে আসন বরাদ্দ হওয়ায়, লাভবান হতে পারে ছোট ও নবগঠিত দলগুলো। ফলে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের জন্য এটি ইতিবাচক না-ও হতে পারে।
প্রচলিত এবং প্রস্তাবিত নির্বাচন ব্যবস্থা: সুবিধা ও অসুবিধা
বর্তমানে বাংলাদেশে ৩০০ আসনে সরাসরি জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন। প্রতিটি ভোটার তার নির্বাচনী এলাকার জন্য একজন প্রার্থী বেছে নেন। কিন্তু নতুন প্রস্তাবিত আনুপাতিক পদ্ধতিতে, সারাদেশে একটি দল যে পরিমাণ ভোট পাবে, সেই ভোটের আনুপাতিক হারে তাদের সংসদে আসন বরাদ্দ করা হবে।
ধরা যাক, কোনো দল ৪০ শতাংশ ভোট পেলে তাদের ৩০০ আসনের মধ্যে ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ১২০টি আসন বরাদ্দ পাবে। ফলে এককভাবে নির্বাচিত হওয়ার ধারণা এখানে আর থাকছে না। নির্বাচনে সাধারণত যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পায় তারা অনেক বেশি আসন পেয়ে যায়, ফলে ছোট দলগুলো তাদের ভোটারদের সঠিক প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পায় না।
আনুপাতিক পদ্ধতির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এটি বাস্তবায়িত হলে সংসদ হবে একটি প্রতিনিধিত্বশীল পার্লামেন্ট, যেখানে এক ভোটের ভিত্তিতে প্রার্থী জয়ী হওয়ার প্রবণতা থাকবে না। এটি ছোট দলগুলোর জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ এনে দেবে বলে অনেকে মনে করছেন।
আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রধান দুটি দলের ভোটের সমীকরণে কী পরিবর্তন আসবে?
বাংলাদেশে ৯০ দশকের পর থেকে এখন পর্যন্ত সংসদীয় পদ্ধতিতে পরিচালিত নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সবসময়ই শীর্ষস্থান দখল করেছে। এই দুটি দলের ভোটের হার প্রায় একই থাকার পরও, জয়ী দল অধিকাংশ আসনে জয়ী হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৩০.৮১ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৪০টি আসন পেয়েছিল, যেখানে আওয়ামী লীগ প্রায় একইরকম ৩০.০৮ শতাংশ ভোট পেয়েও ৯৩টি আসন পায়।
এই অবস্থার পরিবর্তনে আনুপাতিক পদ্ধতি একটি সুব্যবস্থা হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। উদাহরণস্বরূপ, ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৪০.৮৬ শতাংশ এবং আওয়ামী লীগ ৪০.২১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। কিন্তু আনুপাতিক পদ্ধতি চালু হলে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা সমান সমান হতে পারত। এভাবে ভোটের হিসাব মিলিয়ে সংসদে দলগুলোর অবস্থান নির্ধারণ করলে অনেকের মতে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রতি জনগণের আস্থা বাড়বে।
জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামি দলগুলোর লাভের সুযোগ?
আনুপাতিক নির্বাচনে ইসলামি দলগুলো তুলনামূলক বেশি আসন পেতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ছোট ছোট ইসলামি দলগুলো ইতোমধ্যে এই প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রস্তাব তুলে ধরেছে এবং রাষ্ট্র সংস্কারের দিক থেকে আনুপাতিক নির্বাচনকে দেশের জন্য উপযোগী বলে অভিমত ব্যক্ত করেছে।
জামায়াতে ইসলামীর আমীর শফিকুর রহমান বিবিসি বাংলাকে জানান, আনুপাতিক পদ্ধতি বাস্তবায়িত হলে সংসদ হবে জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বশীল। তিনি বলেন, “আমাদের প্রস্তাবের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কোন দলের বিশেষ সুবিধা লাভ হবে না। বরং সংসদে জনগণের প্রকৃত মতামত প্রতিফলিত হবে।”
ছোট দলগুলোর জন্য কী সম্ভাবনা আছে?
বামপন্থী দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে আনুপাতিক পদ্ধতির জন্য সুপারিশ করে আসছে। সিপিবি, গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদের মতো অপেক্ষাকৃত নতুন দলগুলো আনুপাতিক ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিকভাবে ন্যায্য বলে মনে করে। ছোট দলগুলো এখনো দেশের সর্বত্র শক্ত অবস্থান অর্জন করতে না পারলেও নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় তাদের জনপ্রিয়তা রয়েছে।
আনুপাতিক নির্বাচনে এই দলগুলোও আসন পেতে পারে যদি তারা সঠিকভাবে ভোট ভাগাভাগি করতে পারে। তবে জনমত যাচাই করেই মাঠে টিকে থাকতে হবে দলগুলোকে, এই বাস্তবতাও তারা মেনে নিচ্ছে। গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক বলেন, “আমরা দল হিসেবে ক্ষমতার ভাগাভাগি চাই না; বরং রাষ্ট্র সংস্কারের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি, যেখানে জনগণের মতামত বেশি প্রতিফলিত হবে।”
বিএনপি’র বিরোধিতা: কেন তারা আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থায় সায় দিচ্ছে না?
বাংলাদেশে একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি আনুপাতিক নির্বাচনের বিরোধিতা করছে। দলটির অভিমত, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাদের বিজয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। বিএনপি মনে করে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাদের ভোট ও সাংগঠনিক কাঠামোর জন্য তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাবে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশে আনুপাতিক নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক কাঠামো এখনো প্রস্তুত নয়। এটি একটি বিশাল পরিবর্তনের দাবি করে, যা আমাদের পুরো রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর প্রভাব ফেলবে।”
আওয়ামী লীগের সম্ভাবনা: আনুপাতিক নির্বাচন কি দলটির জন্য সহায়ক হবে?
আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরেই তাদের নিজস্ব ভোট ব্যাংক নিয়ে সংসদ নির্বাচনে ভালো করছে। প্রস্তাবিত আনুপাতিক ব্যবস্থায় তারা ভোটের অনুপাত অনুযায়ী আসন পাবে, যার ফলে দলটির জন্য অনেকেই এটি সহায়ক হতে পারে বলে মনে করছেন।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী এবং গণ অধিকার পরিষদের কিছু নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত দিয়ে বলছেন, “আওয়ামী লীগকে রেখে আনুপাতিক নির্বাচনে গেলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।”
আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির বাস্তবায়নে কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন
বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতির পরিবর্তে আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু করতে গেলে বিশাল কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন মনে করেন, “এ ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থায় দলীয় প্রধানরা অধিক ক্ষমতা পাবেন, যা তাদের মনোনীত প্রার্থীদের নির্বাচিত করতে সাহায্য করবে।”
তিনি আরো বলেন, “বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের ভেতরে গণতন্ত্র এখনো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই এই ধরনের পদ্ধতি পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।”
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রভাব এবং ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
বাংলাদেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের পক্ষে-বিপক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ স্পষ্ট। এ ধরনের পরিবর্তন শুধুমাত্র একটি নির্বাচনী পদ্ধতির পরিবর্তন নয়, বরং একটি বৃহৎ সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা।
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের কার্যকারিতা এবং জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী উন্নয়নকাজ করার জন্য শক্তিশালী স্থানীয় সরকার কাঠামো এবং একটি ন্যায্য রাজনীতিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন একটি সুদৃঢ় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।