বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
,

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ঘরে ফেরা: চাঁদাবাজি, হামলার ভয়, আর গোপন জীবনের বাস্তবতা

বাংলাদেশে গত আগস্ট মাসে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে দেশজুড়ে বিরাট এক রাজনৈতিক পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর প্রতিশোধমূলক হামলার খবর ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে। বিএনপি এবং তাদের সমর্থিত আন্দোলনকারীদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা নিজেদের এলাকায় গা ঢাকা দেন।

দেড় মাসেরও বেশি সময় পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে, আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ধীরে ধীরে এলাকায় ফিরতে শুরু করেছেন। কিন্তু বাড়ি ফেরার জন্য তাদের মোটা অঙ্কের অর্থ দিতে হচ্ছে—এমন অভিযোগ শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন সূত্র থেকে। যারা টাকা দিচ্ছেন না বা দিতে পারছেন না, তাদের এলাকায় প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি অনেক জায়গায় হামলার শিকার হওয়ার খবরও পাওয়া যাচ্ছে।

আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি বাংলা। তাদের বেশিরভাগই নিজেদের পরিচয় বা স্থান প্রকাশ করতে রাজি হননি নিরাপত্তার স্বার্থে। তবে তারা বাড়ি ফেরার প্রক্রিয়া এবং এর পেছনের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন।

টাকা দিয়ে এলাকায় ফেরা: টাকার অঙ্ক আর প্রভাবশালীদের ক্ষমতা

আওয়ামী লীগের এক ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা জানান, তিনি তিন লাখ টাকা চাওয়া হলেও, অনেক কথাবার্তার পর এক লাখ টাকা দিয়ে এলাকায় ফিরতে সক্ষম হন। তবে এই প্রক্রিয়াটি সহজ ছিল না। বিএনপি এবং স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা করতে হয়েছে। “এটা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। পরিবারকে ফেলে রেখে কতদিন পালিয়ে বেড়াবো?” — বলেন তিনি।

অনেক এলাকায় বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাই এখন ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিজের এলাকায় ফিরতে হলে তাদের সঙ্গে সমঝোতা করতে হচ্ছে। অর্থ প্রদানের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে। এক নেতা বলেন, “যাদের মাধ্যমে ফিরছি, তাদের বলতেই হচ্ছে ঘর থেকে বের না হতে। বাইরে বের হলে সমস্যা হতে পারে।”

টাকা দিয়েও ফিরতে পারছেন না অনেকেই

সবাই টাকা দিয়েও এলাকায় ফিরতে পারছেন না। এক আওয়ামী লীগ নেতা জানান, তিনি দুই দফায় দেড় লাখ টাকা দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও এলাকায় ফিরতে পারছেন না। “কতজনকে টাকা দেবো? দুজনকে দিয়েছি, এখন আরও লোকজন ফোন করে টাকা চাইছে। সবাইকে কি টাকা দেবো?”— ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। এই পরিস্থিতিতে তিনি হতাশ, কারণ অনেক টাকা খরচ করেও তিনি এলাকায় ফিরতে পারছেন না।

চাঁদা না দিলে হুমকির মুখে

শুধু এলাকায় ফেরার জন্য টাকা দেওয়াই নয়, অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর পরিবারকে হামলার হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে। ঢাকার কাছাকাছি এক আওয়ামী লীগ নেতা জানান, তার স্ত্রীকে হুমকি দেওয়া হয়েছে, যেন এক সপ্তাহের মধ্যে ৫০ হাজার টাকা রেডি রাখে। টাকা না দিলে বাড়িতে হামলা চালানো হবে বলে হুমকি দিয়েছে।

এ বিষয়ে ওই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, “চাঁদা চাওয়া লোকগুলো আমাদের এলাকারই। এতদিন সেভাবে তাদের রাজনীতি করতে দেখিনি। এখন বলছে, তারা নাকি যুবদলের।” অর্থাৎ, বর্তমান পরিস্থিতিতে স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপি এবং এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠছে।

এলাকায় ফেরা: নিরাপত্তাহীনতা ও হামলার ভয়

যারা এলাকায় ফিরতে সক্ষম হয়েছেন, তাদের অনেকেই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছেন না। বাড়িতে থেকে বের হওয়ার সাহস পাচ্ছেন না তারা। এক ওয়ার্ড পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা জানান, তার কাপড়ের দোকান গত দেড় মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। দোকান খোলার সাহস পাচ্ছেন না, কারণ বাইরে বের হলেই হামলার শিকার হতে পারেন।

হামলা ও হত্যার ঘটনা

এলাকায় ফেরার পর যারা প্রকাশ্যে ঘুরছেন, তাদের অনেকে হামলার শিকার হচ্ছেন। খুলনার এক ছাত্রলীগ নেতা শফিকুল ইসলাম মুন্নার ওপর সম্প্রতি হামলা হয়েছে। তার আত্মীয় জানান, “তিন-চার জনে মিলে দৌড়ানি দিয়ে ওকে রাস্তায় ফেলে কুপিয়েছে।” হামলায় গুরুতর আহত মুন্না বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি আছেন।

এছাড়াও, লক্ষ্মীপুরে নূর আলম নামে এক আওয়ামী লীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে। এছাড়া বরিশাল ও চুয়াডাঙ্গায় গত সপ্তাহে ছাত্রলীগের তিন নেতাকে কুপিয়ে আহত করার খবর পাওয়া গেছে।

বিএনপির প্রতিক্রিয়া: অভিযোগ অস্বীকার

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে বিএনপির শীর্ষ নেতারা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, “আমাদের নেতাকর্মীরা এমন ঘটনার সঙ্গে জড়িত হবে বলে আমি মনে করি না।” তিনি আরও বলেন, ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ যেভাবে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে, তাতে এই অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে মনে হচ্ছে।

বিএনপির অপর এক নেতা শামা ওবায়েদ বলেন, “কেউ যদি বিএনপির নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত থাকে, তার বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিএনপির পক্ষ থেকে এরকম কোনো কার্যক্রমের অনুমোদন দেওয়া হয়নি।”

রাজনৈতিক সংকট: নেতৃত্বের শূন্যতা ও ভবিষ্যতের দিশা

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ঘরে ফেরা নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা দলের জন্য আরও বড় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। দলটির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে অনেকে এখনও আত্মগোপনে আছেন, কেউ কেউ দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। এই রাজনৈতিক শূন্যতা এবং নেতৃত্ব সংকট দলটির ভবিষ্যতের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ করা এবং উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতার প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি হয়ে উঠেছে। একদিকে বিএনপির নেতারা তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করলেও, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা তাদের এলাকায় ফেরার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।

পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দুই দলেরই উচিত দ্রুততার সঙ্গে সমঝোতার পথ খুঁজে বের করা, যা দেশের স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।

আরও পড়তে পারেন