আইপিএল ২০২৫-এর নিলামে কোনও বাংলাদেশি ক্রিকেটারের নাম উঠলেও তাদের পক্ষে কোনও বিড করা হয়নি।
১৩ জন বাংলাদেশি ক্রিকেটার আইপিএলের নিলামে নিবন্ধিত থাকলেও মাত্র দু’জনকে শর্টলিস্ট করা হয়েছিল।
মোস্তাফিজুর রহমান ও রিশাদ হোসেন ছিলেন সেই দুই শর্টলিস্ট হওয়া খেলোয়াড়।
মোস্তাফিজুর রহমান আইপিএলে অভিজ্ঞ হলেও এবারের নিলামে তিনি কোনও ফ্র্যাঞ্চাইজির আগ্রহ পাননি।
তার বেস প্রাইস ছিল দুই কোটি রুপি, যা ফ্র্যাঞ্চাইজির কাছে হয়তো খুব বেশি লেগেছে।
রিশাদ হোসেন, যিনি সম্প্রতি বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে ভালো পারফর্ম করেছিলেন, তাকেও কেউ দলে টানেনি।
বিশ্বকাপে ১৪টি উইকেট নেওয়ার পরও ভারতীয় সিরিজে তার দুর্বল পারফরম্যান্স তার অবস্থানকে দুর্বল করে দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, টানা ভালো পারফরম্যান্স না থাকা এবং অভিজ্ঞতার অভাবই রিশাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়েছে।
মোস্তাফিজুর রহমানের নাম নিলামের দ্বিতীয় দিনে ওঠে, যখন ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো তাদের বাজেটের বড় অংশ ইতোমধ্যেই ব্যবহার করে ফেলেছে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) অনুরোধে ২০২৪ সালের আইপিএল ছেড়ে দেশে ফিরে আসার ঘটনাও মোস্তাফিজের বিপক্ষে গেছে।
ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো দীর্ঘ মেয়াদে বিশ্বাসযোগ্য খেলোয়াড়কে চাই, যা বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের অভাবে ফেলেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
আইপিএলে বাংলাদেশের প্রভাব কমে যাওয়ার ইঙ্গিত
বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের আইপিএলে প্রভাব একসময় উল্লেখযোগ্য ছিল।
সাকিব আল হাসান ছিলেন দীর্ঘদিন ধরে আইপিএলের অন্যতম সফল বাংলাদেশি খেলোয়াড়।
তিনি কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে আইপিএল শিরোপাও জিতেছেন।
কিন্তু গত কয়েক মৌসুম ধরে সাকিবের পারফরম্যান্স এবং দলগুলোর চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য থাকছে না।
গত মৌসুমে মিনি নিলামে সাকিবের নাম এলেও কোনও দল তার জন্য বিড করেনি।
২০২৫ সালের নিলামে সাকিবের নামই শর্টলিস্ট করা হয়নি।
মোস্তাফিজ, যিনি আইপিএলে অভিজ্ঞ, তিনিও এবার নিলামে কোনো আগ্রহ পাননি।
অন্যদিকে, আফগান ক্রিকেটাররা ক্রমাগত আইপিএলে তাদের উপস্থিতি বাড়িয়ে চলেছেন।
২০২৫ সালের আইপিএলে সাতজন আফগান ক্রিকেটার বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে খেলবেন।
তাদের মধ্যে রয়েছেন রশিদ খান, যিনি ইতোমধ্যেই আইপিএলে একজন তারকা খেলোয়াড়।
আফগানিস্তান থেকে আরও কয়েকজন প্রতিভাবান খেলোয়াড় আইপিএলের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আইপিএলের প্রতি ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর আগ্রহ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে বড় স্কোর করার দক্ষতা এবং ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের ঘাটতি এর মূল কারণ হতে পারে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের একজন পরিচালক বলেছেন, বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের গুণগত মান আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে প্রত্যাশিত স্তরে নেই।
একই সময়ে, আফগানিস্তানের খেলোয়াড়রা নিজেদের আন্তর্জাতিক মঞ্চে এবং আইপিএলে প্রমাণ করতে সফল হয়েছেন।
২০১৮ সালে আইপিএলে মোস্তাফিজুর রহমান সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের হয়ে সফল মৌসুম কাটিয়েছিলেন।
কিন্তু সেই ফর্ম তিনি সাম্প্রতিক মৌসুমগুলোতে ধরে রাখতে পারেননি।
বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের আইপিএলে অংশগ্রহণের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসা দেশটির টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্য একটি সংকেত হতে পারে।
আইপিএল নিলামের পূর্ববর্তী ইতিহাসে পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের অভিজ্ঞতা
আইপিএলে পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের ভূমিকা শুরু থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু ২০০৮ সালের মুম্বাই সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে তাদের অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা চলে আসে।
পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা প্রথম আইপিএল সিজনে যোগ দিয়েছিলেন এবং এই দেশটির ক্রিকেটাররা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন।
তবে ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক আরও খারাপ হয়ে ওঠে, যার প্রভাব পড়ে ক্রিকেট সম্পর্কেও।
ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (বিসিসিআই) তখন থেকেই পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের আইপিএলে অংশ নিতে দেয়নি।
২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা আইপিএলে অংশগ্রহণ করতে পারেননি।
এদিকে, পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কও কিছুটা বৈরী হয়ে উঠেছে, বিশেষত রাজনৈতিক বিবেচনায়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সীমান্তের ঘটনা পরিক্রমার সঙ্গে সম্পর্কিত আইপিএলের সিদ্ধান্তের মধ্যে কোনও সরাসরি যোগসূত্র না থাকলেও, পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের আইপিএল থেকে বাদ পড়া একই ধরনের একটি পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয়।
এখন প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জন্য এই নিষ্ক্রিয়তা কি শুধুই পারফরম্যান্সের কারণে, না কি রাজনৈতিক পটভূমিতে এর একটি বৃহত্তর কারণ রয়েছে?
বিশ্ব ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধুমাত্র একটি দেশের ক্রিকেটীয় পারফরম্যান্সের উপর ভিত্তি করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি; বরং এর সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও।
বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনা এর পেছনে কিছুটা প্রভাব ফেলতে পারে বলে কিছু অনেকে ধারণা করছেন, যদিও বিসিসিআই বা আইপিএল কর্তৃপক্ষ এর সঙ্গে কোনও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছে।
তবে এটি নিঃসন্দেহে ক্রিকেট এবং রাজনীতির জটিল সম্পর্ককে উন্মোচন করছে, যা ক্রিকেটের উন্নয়ন এবং খেলোয়াড়দের ক্যারিয়ারকে প্রভাবিত করছে।
রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং এর প্রভাব আইপিএল ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে
ভারত এবং বাংলাদেশের সম্পর্কের সাম্প্রতিক উত্তেজনা এবং বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন বক্তব্যও এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।
বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং ভারতে এই ঘটনাবলি নিয়ে আলোচনার ফলে দুই দেশের মধ্যে মনোমালিন্য তৈরি হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে, কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, ভারতীয় ফ্র্যাঞ্চাইজিরা তাদের দলগুলোর জন্য বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের নিয়ে কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি।
এমনকি ভারতীয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিভিন্ন মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং সেখানে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন বিষয়ক প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
এই ধরনের পরিস্থিতি আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় কিছুটা প্রভাব ফেলতে পারে, যদিও বিসিসিআই এ বিষয়টি অস্বীকার করেছে।
এদিকে, বাংলাদেশের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ভারতীয় গণমাধ্যমকে লক্ষ্য করে অভিযোগ করেছেন, যারা বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিপক্ষে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
তিনি মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশে জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য যে কোনো প্রতিবন্ধকতা সহ্য করা হবে না।
এই জটিল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ক আরও সংকটপূর্ণ হয়ে উঠেছে, যা ক্রিকেটের ওপরও প্রভাব ফেলছে।
বিশ্বকাপের পরও দুই দেশের সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়েছে, আর এর প্রতিফলন দেখা গেছে আইপিএল নিলামের সিদ্ধান্তে।
যদিও এটা বলা কঠিন যে, রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের আইপিএল থেকে বাদ পড়া সরাসরি ঘটেছে, তবে কিছু আভাস অবশ্যই পাওয়া যাচ্ছে যে, পারফরম্যান্সের পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতাও একটি প্রভাব ফেলেছে।
এর মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্কের জটিলতা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ও ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করেছে।
আইপিএলের মতো বৃহৎ ক্রিকেট লিগের দলগুলোর পক্ষে খেলোয়াড় নির্বাচন এখন শুধু পারফরম্যান্সের বিষয় নয়, বরং রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি এবং দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতিও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া, বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ডও জানিয়ে দিয়েছে যে, খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতেই তারা আইপিএলে জায়গা পাবে, এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা বা অন্যান্য কারণে আইপিএল কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে কোনো প্রভাব পড়বে না।
তবে, কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, ক্রিকেট কখনোই শুধুমাত্র খেলা নয়, এটি রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনেক কিছু প্রভাবিত করে।