গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
তিন মাসের অনুসন্ধান শেষে কমিটি আজ তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পাচার হওয়া অর্থ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং জনগণের জীবনমান উন্নয়নের পথে বড় বাধা তৈরি করেছে।
“গরিবের রক্ত পানি করা টাকা লুট হয়েছে”: ইউনূস
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শ্বেতপত্রটি গ্রহণ করে এই কাজকে “ঐতিহাসিক দলিল” হিসেবে অভিহিত করেন।
তিনি বলেন, “আমাদের গরিব মানুষের রক্ত পানি করা টাকা যেভাবে লুণ্ঠন করা হয়েছে, তা আতঙ্কজনক।”
তিনি আরও বলেন, “এই তথ্য স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষার্থীদের শেখানো উচিত।”
ড. ইউনূস অভিযোগ করেন, দুর্নীতির এই ভয়াবহ চিত্রের সময়ে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলো নীরব ছিল।
শ্বেতপত্রের তথ্যকে জাতির জন্য শিক্ষণীয় এবং ভবিষ্যতে আর্থিক শুদ্ধতার প্রেক্ষাপট তৈরির নির্দেশিকা হিসেবে গণ্য করার আহ্বান জানান তিনি।
বড় প্রকল্পে লুটপাটের বিশাল চিত্র
শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, বিগত শাসনামলে বাস্তবায়িত ২৯টি বড় প্রকল্পে ব্যয়ের ধোঁয়াশা এবং অর্থ লুটপাট ঘটেছে।
কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, সাতটি বড় প্রকল্পের ব্যয় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা থেকে ১ লাখ ৯৫ হাজার কোটিতে উন্নীত করা হয়।
জমির মূল্য বেশি দেখানো, অতিরিক্ত উপাদান যোগ করা এবং ক্রয়ের ক্ষেত্রে হেরফের করে প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়।
এই প্রকল্পগুলোতে ব্যয়ের সুবিধা বিশ্লেষণ ছাড়াই অর্থ ব্যয় বাড়ানো হয়েছে বলে শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়।
“৪০ শতাংশ উন্নয়ন বাজেট আমলাদের লুট”: অধ্যাপক এনামুল
কমিটির সদস্য অধ্যাপক এ কে এনামুল হক জানান, গত ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ৭ লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে।
এর মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ অর্থ আমলাদের দ্বারা লুটপাট হয়েছে।
তিনি জানান, উন্নয়ন খাতে এই অর্থ অপচয়ের ফলে দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বৃদ্ধির সুযোগ হারিয়েছে বাংলাদেশ।
অন্যদিকে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের ১০ শতাংশ অর্থও অবৈধ লেনদেনে খোয়া গেছে।
এই পরিমাণ দাঁড়ায় কমপক্ষে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
“ক্রনি ক্যাপিটালিজম” ও নীতিনির্ধারণে প্রভাব
কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “চামচা পুঁজিবাদ (ক্রনি ক্যাপিটালিজম) অলিগার্কদের জন্ম দিয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “এই অলিগার্করা নীতি প্রণয়নে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে অর্থনৈতিক অব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে।”
কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এই অর্থনৈতিক অনিয়ম সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রভাব ফেলেছে।
অন্যদিকে, কর অব্যাহতির হার কমানো গেলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বাজেটে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করা যেত বলে জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে কর অব্যাহতির পরিমাণ দেশের মোট জিডিপির ছয় শতাংশের সমান ছিল বলে উল্লেখ করা হয়।
শ্বেতপত্রের দ্রুত প্রকাশের আহ্বান
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় জানিয়েছে, এই প্রতিবেদন শিগগিরই জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হবে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এই প্রতিবেদনের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।
শ্বেতপত্রের তথ্য অর্থ পাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে নীতিগত পদক্ষেপ নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়।
শ্বেতপত্রটি দেশের অর্থনৈতিক নীতি এবং প্রশাসনিক কাঠামোর সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা আরও একবার সামনে নিয়ে এসেছে।