,

অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন: প্রতিশ্রুতি পূরণের চিত্র

জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে তাদের যাত্রা শুরু করেছিল।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, তা পূরণের দায়িত্ব নিয়েছিল নতুন সরকার।

অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের সামনে যে প্রতিশ্রুতিগুলো দিয়েছিল, তার মধ্যে ছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়ন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কার।

গণঅভ্যুত্থানের সময় মানুষের যে সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগ, তার প্রতি সম্মান জানিয়ে একটি নতুন ও স্থিতিশীল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছিল এই সরকার।

তবে প্রথম ১০০ দিনের সময়সীমা পেরিয়ে এসে বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলছেন—সরকার প্রতিশ্রুতি পূরণে কতটুকু সফল?

“গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তাদের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা ছিল আকাশছোঁয়া। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন,” বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জোবাইদা নাসরীন।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি: নিয়ন্ত্রণে কি অগ্রগতি হয়েছে?

ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি।

গণঅভ্যুত্থানের সময় পুলিশের অনুপস্থিতি এবং রাজনৈতিক শূন্যতার কারণে দেশে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়।

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি এবং হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।

বিশেষ করে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় সংঘটিত গণছিনতাই এবং বিহারি ক্যাম্পে খুনোখুনির ঘটনা ছিল অত্যন্ত আলোচিত।

এমনকি সন্ধ্যার পর মানুষ বাড়ি থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সেনাবাহিনীর মাঠে নামার পর পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হলেও জনগণের মনে আতঙ্ক কাটেনি।

“আগে রাতে ১২টা-১টা পর্যন্ত বাইরে থাকা যেত, কিন্তু এখন সন্ধ্যার পরেই মনে হয় তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যাই,” বলছিলেন ঢাকার বাসিন্দা জেসমিন।

গত ১০০ দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনিতে কমপক্ষে ৬৮ জন নিহত হয়েছেন।

এছাড়া ধর্ষণ এবং অন্যান্য সহিংস ঘটনার সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।

এ পরিস্থিতি নিয়ে সমালোচকরা বলছেন, পুলিশ বাহিনী এখনো পুরোপুরি সক্রিয় হতে পারেনি।

“আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য শুধুমাত্র সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো যথেষ্ট নয়। পুলিশের কার্যক্রম পুরোপুরি স্বাভাবিক করতে হবে,” বলছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক।

সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য দাবি করা হয়েছে যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করতে পুলিশের পুনর্গঠন এবং নতুন সদস্য নিয়োগের কাজ চলছে।

তবে এই কাজে আরও গতি আনা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি: সরকারের ব্যর্থতা?

অর্থনৈতিক সংকট এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আগের সরকারের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল।

নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।

কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আরও বেড়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বেশি—১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

চাল, তেল, চিনি, এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকায় সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়েছে।

“জিনিসপত্রের দাম এত বেড়েছে যে বাজার করতে গেলেই মাথা ঘুরে যায়। ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া চালাতে গিয়ে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে,” বলছিলেন ঢাকার ধানমণ্ডির বাসিন্দা শায়লা সুলতানা।

সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে শুল্ক কমানো এবং বাজার তদারকির ব্যবস্থা করলেও তার প্রভাব খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাজার ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

“মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য শুধু অর্থনৈতিক নীতি পরিবর্তন নয়, বাজারে সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে,” বলছেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।

সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য দাবি করা হয়েছে যে, বন্যার কারণে সাম্প্রতিক কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় পণ্যের মূল্য বেড়েছে।

খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন, “আমরা আশা করছি, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বাজার পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”

রাষ্ট্র সংস্কার: অগ্রগতি কতটুকু?

রাষ্ট্র সংস্কার ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতি।

ক্ষমতা গ্রহণের পরই সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ এবং জনপ্রশাসনে সংস্কারের লক্ষ্যে বিভিন্ন কমিশন গঠন করা হয়।

প্রথম ধাপে ছয়টি এবং পরবর্তী ধাপে আরও চারটি নতুন কমিশন গঠন করা হয়েছে।

তবে এই কমিশনগুলোর কাজ এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে।

“সরকার সংস্কার প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক অগ্রগতি দেখালেও এর গতি খুব ধীর। মানুষ দ্রুত পরিবর্তন দেখতে চায়,” বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জোবাইদা নাসরীন।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ জরুরি।

এছাড়া এই সংস্কার প্রক্রিয়ার একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

নির্বাচন কবে হবে?

নির্বাচন আয়োজন নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা কাটেনি।

অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ছিল একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন।

তবে তিন মাসের মাথায় এসে নির্বাচন নিয়ে সরকারের সুস্পষ্ট কোনো রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়নি।

ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকার বলে আসছে, নির্বাচন হবে রাষ্ট্র সংস্কার শেষ করার পর।

কিন্তু সংস্কারের কাজ কতদিনে শেষ হবে, তা নিয়ে এখনও নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা দেওয়া হয়নি।

“নির্বাচন একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আমাদের কাজ হলো সংস্কারের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা, যাতে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর হয়,” সম্প্রতি বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

অন্যদিকে, বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের জোট দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “সংস্কারের নামে সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হোক। যত দ্রুত নির্বাচন হবে, ততই জাতির জন্য মঙ্গল।”

বিরোধী দলগুলোর দাবি হচ্ছে, জনগণ রাষ্ট্র সংস্কার দেখতে চায় ঠিকই, তবে তার চেয়েও বেশি জরুরি হলো জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা।

তারা মনে করে, নির্বাচনের মাধ্যমেই প্রকৃত রাষ্ট্র সংস্কার শুরু হতে পারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার সময়মতো নির্বাচন না দিলে তাদের প্রতি জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ণ হতে পারে।

তাছাড়া, বিরোধী দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন নিয়ে অসন্তোষ বাড়লে রাজনৈতিক উত্তেজনা নতুন করে সৃষ্টি হতে পারে।

এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ডে আরও গতিশীলতা আনতে হবে বলে মনে করেন তারা।

“নির্বাচন প্রক্রিয়া চালু করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আরও সক্রিয় আলোচনা প্রয়োজন। সরকারকে তাদের উদ্দেশ্য ও সময়সীমা পরিষ্কারভাবে জানাতে হবে,” বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জোবাইদা নাসরীন।

এদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা হয়েছে এবং সার্চ কমিটি সক্রিয় রয়েছে।

তবে প্রক্রিয়া কতদিনে শেষ হবে, সেটি এখনও অনিশ্চিত।

অর্থনীতির পুনরুদ্ধার

অর্থনৈতিক সংকট ছিল আগের সরকারের পতনের অন্যতম বড় কারণ।

রিজার্ভের ঘাটতি, মুদ্রাস্ফীতি এবং ব্যাংকিং খাতে অব্যবস্থাপনার কারণে দেশের অর্থনীতি একটি সংকটপূর্ণ অবস্থায় চলে গিয়েছিল।

নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

প্রথম তিন মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা বাড়ানো সম্ভব হয়েছে।

বর্তমানে রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে, যা আগের ১৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যাওয়ার তুলনায় ভালো অবস্থায় আছে।

তবে মূল্যস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য এখনও বড় সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে।

“রিজার্ভ বাড়ানো একটি ইতিবাচক দিক, তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এখনও তেমন অগ্রগতি নেই,” বলেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।

গত তিন মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্যই কমেছে।

অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ, যা আগের মাসের তুলনায় খুব বেশি হ্রাস পায়নি।

ব্যাংকিং খাতের সংকট এখনও কাটেনি।

অনেক দুর্বল ব্যাংক এখনও গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য সহায়তার ঘোষণা দিলেও তাদের কার্যক্রম পুনর্গঠনে আরও সময় লাগবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

“সুদের হার এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য আরও কঠোর নীতি প্রয়োজন,” বলছেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরী।

অন্তর্বর্তী সরকার অবশ্য জানিয়েছে, ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে একটি বিশেষ কমিশন গঠন করা হয়েছে।

তারা খেলাপি ঋণ এবং পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধারের কাজেও মনোযোগ দিচ্ছে।

তবে সমালোচকরা বলছেন, শুধু নীতিগত পরিবর্তন নয়, এর দ্রুত বাস্তবায়নও জরুরি।

অন্যথায়, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার যে লক্ষ্য, তা অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে।

চ্যালেঞ্জের পথে সরকার

প্রথম ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকার কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি দেখাতে পেরেছে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হয়েছে, তবে জনগণের আস্থা পুরোপুরি অর্জন করা যায়নি।

দ্রব্যমূল্য এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকার এখনও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে।

রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন ইতিবাচক দিক হলেও এর কাজ আরও দ্রুত করতে হবে।

নির্বাচনের বিষয়ে কোনো স্পষ্ট রোডম্যাপ না থাকায় রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়তে পারে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়সীমা যত বাড়বে, ততই তাদের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা এবং চাপ বৃদ্ধি পাবে।

“সরকারকে দ্রুত তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যথায়, মানুষের হতাশা বাড়বে এবং সরকারের প্রতি আস্থা কমে যাবে,” বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক।

আগামী কয়েক মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করবে তাদের নেওয়া পদক্ষেপের কার্যকারিতা এবং জনগণের আস্থা অর্জনের ওপর।

এখন দেখার বিষয়, সরকার কীভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এবং তাদের প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়ন করতে পারে।

আরও পড়তে পারেন