বাংলাদেশ পুলিশ
,

গণঅভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে

বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রথম ১০০ দিনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে।

৫ আগস্টের পর থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের অনুপস্থিতি এবং অস্থির পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে।

ছিনতাই, ডাকাতি এবং হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

বিশেষ করে ঢাকা এবং এর আশপাশের এলাকায় এই সংকট সবচেয়ে প্রকট হয়ে উঠেছে।

ইজিবাইক চালকদের মধ্যে আতঙ্ক

ইজিবাইক চালক মোহাম্মদ শামীম জানান, ঋণ করে কেনা তার ইজিবাইকটি গত সপ্তাহে ছিনতাই হয়েছে।

ছিনতাইকারীরা তাকে অজ্ঞান করে তার আয়-রোজগারের একমাত্র উপায়টি কেড়ে নেয়।

শামীম বলেন, “গত তিন মাসে ডজনের বেশি ইজিবাইক ছিনতাই হয়েছে, এর মধ্যে চারজন চালককে খুন করা হয়েছে।”

তার মতে, এখন অনেক চালক রাতে গাড়ি নিয়ে বের হতে ভয় পাচ্ছেন।

গত দুই সপ্তাহে রূপগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ এবং ঝিনাইদহে ইজিবাইক চালকদের হত্যা করে গাড়ি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে।

মোহাম্মদপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি

ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য বিশেষভাবে আলোচিত।

বিহারী ক্যাম্পে খুনোখুনি, ছিনতাই এবং সশস্ত্র মহড়ার ঘটনা ঘটছে নিয়মিত।

জেনেভা ক্যাম্পসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযানে শতাধিক সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও স্থানীয় বাসিন্দারা এখনো আতঙ্কে আছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা জেসমিন বলেন, “আগে রাতে বারোটা-একটায় মানুষ বাইরে যেত। এখন ভয় পাচ্ছে, সন্ধ্যার পরে আর বের হতে সাহস করছে না।”

একজন অভিভাবক জানান, তিনি এখন তার সন্তানকে স্কুলে নিয়ে আসার সময় অতিরিক্ত নিরাপত্তার জন্য হিজাব পরিয়ে আনেন।

পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সমন্বিত কার্যক্রম

সিদ্ধিরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ আল মামুন জানান, ৫ আগস্টের পর প্রায় এক মাস পুলিশের অনুপস্থিতি ছিল।

তিনি বলেন, “সেপ্টেম্বরের সাত তারিখে আমি জয়েন করার পর ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার কাজ শুরু করেছি।”

তবে যানবাহনের সংকটে টহল ব্যবস্থায় সীমাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।

মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান বলেন, “ডাকাতি ও অন্যান্য অপরাধের আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আরো সময় প্রয়োজন।”

গণপিটুনি ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা

গত তিন মাসে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন অন্তত ৬৮ জন।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সানাড়পাড় বাস স্ট্যান্ডে এক পুলিশ সদস্যকে ‘ভুয়া পুলিশ’ আখ্যা দিয়ে গণপিটুনির শিকার হতে হয়েছে।

সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ নিশ্চিত করে যে আক্রান্ত ব্যক্তি আসলে একজন প্রকৃত পুলিশ সদস্য ছিলেন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান জেড আই খান পান্না এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, “সাজাপ্রাপ্ত সন্ত্রাসীদের মুক্তি এবং পুলিশের শূন্যতার কারণে অপরাধীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে।”

সরকারের পদক্ষেপ

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার একাধিক পদক্ষেপ নিচ্ছে।

ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব জানান, আগামী তিন মাসের মধ্যে পরিস্থিতি উন্নত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

তিনি বলেন, “আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা।”

নতুন করে পুলিশ এবং আনসার নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

সেনাবাহিনীকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত মাঠে রাখার পরিকল্পনাও রয়েছে।

সেনাবাহিনীর ভূমিকা

সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা থাকাকালীন সাত শতাধিক বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।

লুট হওয়া ৬ হাজার অস্ত্র এবং দুই লক্ষাধিক গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।

সেনা সদর জানিয়েছে, এ পর্যন্ত আড়াই হাজার ব্যক্তি গ্রেপ্তার হয়েছেন।

সেনা সদরের কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, “পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সমন্বিতভাবে কাজ চলছে। ভবিষ্যতে সিচ্যুয়েশন আরো ভালো হবে বলে আমরা আশাবাদী।”

সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা

অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি এবং নিরাপত্তার অভাবে সাধারণ মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।

অনেকে মনে করেন, সরকারের উচিত দ্রুত এবং কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া।

একজন নারী বলেন, “আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমাদের প্রধান চাওয়া নিরাপত্তা।”

তিনি বলেন, “যে সরকারই আসুক, আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাদের দায়িত্ব।”

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দাবি, তারা জনগণের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পুলিশের কার্যক্রম আরও জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সরকার আশা করছে, আগামী তিন মাসের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, সরকার তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনবে।

আরও পড়তে পারেন